?> আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা - Ena School

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর “আমি কিংবদন্তির কথা বলছি” কবিতায় কবি তার পূর্বপুরুষের কথা বলেছেন, যারা ছিলেন সংগ্রামী, পরিশ্রমী এবং কবিতার প্রতি গভীর অনুরাগী। নিচে আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার মূলভাব

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর “আমি কিংবদন্তির কথা বলছি” কবিতায় কবি আমাদের পূর্বপুরুষের সংগ্রামের কথা বলেন, যারা মাটি, প্রকৃতি ও কবিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করতেন। তাদের হাতে ছিল মাটির গন্ধ, পিঠে শোষণের ক্ষত—যেন রক্তজবা ফুলের মতো লাল। এই ক্ষত তার জীবনসংগ্রাম ও নিপীড়নের ইতিহাস বহন করে। আমাদের পূর্বপুরুষ পাহাড়, জঙ্গল, অনাবাদি জমিতে চাষ করতেন এবং সত্য কথাকে কবিতা হিসেবে দেখতেন। কবির মতে, যারা কবিতা বোঝে না, তারা জীবনের গভীরতা অনুভব করতে পারে না।

কবির মা বলতেন, নদী সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু যারা কবিতা বোঝে না, তারা জীবনের স্রোতে ভাসতে পারে না। কবি ভালোবাসা, ত্যাগ ও যুদ্ধের কথা বলেছেন—যেখানে মাতৃভূমির জন্য আত্মত্যাগই শ্রেষ্ঠ সত্য। তিনি বলেন, ভালোবাসার কারণে মানুষ যুদ্ধে যায়, পরিবারকে ছাড়তে হয়, কিন্তু যারা কবিতা বোঝে না, তারা এই আত্মত্যাগের গভীরতা অনুভব করতে পারে না। কবি তার পূর্বপুরুষের কঠোর পরিশ্রম, সংগ্রাম ও আত্মমর্যাদার কথা স্মরণ করেন।

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।”
কবি শুরু করছেন আমাদের পূর্বপুরুষের গল্প দিয়ে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন কিংবদন্তি মানুষ, যারা সংগ্রামী জীবনযাপন করেছেন এবং তাদের জীবনের গল্প পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। কবি বলছেন, তিনি শুধু একজন মানুষের কথা বলছেন না, বরং একটি পুরো জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা বলছেন।
“তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল।”
আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন মাটির মানুষ। তার হাতের তালুতে মাটির গন্ধ ছিল, যা তার কঠোর পরিশ্রম ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের প্রতীক। কিন্তু তার পিঠে ছিল রক্তজবার মতো ক্ষত, যা তার জীবনের যন্ত্রণা, শোষণ এবং সংগ্রামের চিহ্ন। এই ক্ষতগুলো তার অতীতের বেদনাদায়ক ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
“তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন।”
আমাদের পূর্বপুরুষ পাহাড়, জঙ্গল এবং হিংস্র প্রাণীদের কথা বলতেন। এই সবকিছু তার জীবনের সংগ্রামের প্রতীক। পাহাড় অতিক্রম করা, জঙ্গলে বেঁচে থাকা এবং হিংস্র প্রাণীদের মোকাবিলা করা—এগুলো তার সাহসিকতা ও অধ্যবসায়ের পরিচয়।
“পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।”
তিনি অনাবাদি জমি চাষ করে সফল হয়েছিলেন, যা তার পরিশ্রম ও সৃজনশীলতার প্রতীক। তিনি কবি এবং কবিতার কথাও বলতেন, কারণ কবিতাই তার কাছে সত্য ও সুন্দরের প্রকাশ ছিল।
“জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।”
কবি বলছেন, সত্য কথা বলাই হলো কবিতা। আর মাটি চাষ করে যে শস্য ফলানো হয়, তা-ও কবিতার মতোই সুন্দর। অর্থাৎ, সত্য এবং সৃজনশীল কাজ—দুই-ই কবিতার সমান মূল্যবান।
“যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।”
যারা কবিতা বুঝতে পারে না, তারা জীবনের গভীর সত্য থেকে বঞ্চিত। তারা শুধু ঝড়ের শব্দ শুনতে পায়, কিন্তু তার অর্থ বুঝে না। অর্থাৎ, তারা জীবনের সংগ্রাম ও যন্ত্রণা দেখে, কিন্তু তার পেছনের সত্য ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে না।
“যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।”
যারা কবিতা বুঝে না, তারা মুক্ত জীবনের স্বাদ পায় না। তারা দিগন্তের মতো বিশাল ও মুক্ত জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের জীবন সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে।
 “যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।”
যারা কবিতা বুঝে না, তারা আজীবন দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা থাকে। তারা মুক্ত হতে পারে না, কারণ তারা সত্য ও সুন্দরকে চিনতে পারে না।
“আমি উচ্চারিত সত্যের মতো স্বপ্নের কথা বলছি।”কবি বলছেন, তিনি শুধু সত্যের কথা বলছেন না, বরং স্বপ্নের কথাও বলছেন। তার স্বপ্ন হলো একটি মুক্ত ও সুন্দর জীবন, যেখানে সবাই সত্য ও কবিতার মূল্য বুঝতে পারবে।
“উনোনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।”
আগুন সবকিছু শুদ্ধ করে। কবি বলছেন, আগুনের মাধ্যমে শুদ্ধ হয়ে একটি উজ্জ্বল জানালা খুলে যায়, যা আলো ও মুক্তির প্রতীক। 
“আমি আমার মায়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাঁতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।”
কবি তার মায়ের কথা বলছেন, যিনি বলতেন, নদী সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এমনকি যারা সাঁতার জানে না তাদেরও। কিন্তু যারা কবিতা বুঝে না, তারা নদীর স্রোতে ভাসতে পারে না। অর্থাৎ, তারা জীবনের প্রবাহে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না।
“যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না।”
যারা কবিতা বুঝে না, তারা মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারে না। তারা জীবনের সহজ ও সুন্দর মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে পারে না।
“আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি।”
কবি পরিবারের কথা বলছেন। বোনের মৃত্যু এবং মায়ের স্নেহ আমাদের হৃদয়ে গভীর দাগ কেটেছে। এই সবকিছু আমাদের জীবনের বেদনা ও ভালোবাসার প্রতীক।
“ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে।”
কবি বলছেন, দেশের জন্য ভালোবাসা দিলে মাকে ছাড়তে হয়। যুদ্ধে যেতে হয়, পরিবারকে ছাড়তে হয়। কিন্তু এই ভালোবাসাই মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
“যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃৎপিণ্ডে ধরে রাখতে পারে না।”
যারা কবিতা বুঝে না, তারা সূর্যের মতো আলো ও শক্তিকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না।
“আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।”
কবি আবারও আমাদের পূর্বপুরুষের কথা বলছেন। আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন একজন কিংবদন্তি মানুষ, যিনি সংগ্রামী জীবনযাপন করেছেন এবং তার গল্প পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
“তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।”
পূর্বপুরুষ ছিলেন একজন ক্রীতদাস। তার পিঠের ক্ষত তার শোষণ ও সংগ্রামের ইতিহাস বলে। এই ক্ষতগুলো তার অতীতের বেদনাদায়ক ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
“যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।”
যে মাটি চাষ করে, সে শস্য পায় এবং সমৃদ্ধ হয়। এখানে কবি বলছেন, পরিশ্রম ও সংগ্রামের মাধ্যমেই মানুষ সাফল্য পায়।
“যে মৎস্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।”
যে মাছ লালন-পালন করে, নদী তাকে পুরস্কৃত করবে। অর্থাৎ, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখলে প্রকৃতি মানুষকে পুরস্কৃত করে।
“যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।”
যে গরুর যত্ন নেয়, মা যেমন সন্তানের যত্ন নেন, তেমনি প্রকৃতিও তার যত্ন নেয় এবং তাকে দীর্ঘায়ু করে।
“যে লৌহখণ্ডকে প্রজ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।”
যে লোহাকে আগুনে পুড়িয়ে তরবারি বানায়, সে শক্তিশালী হয়। এখানে কবি বলছেন, সংগ্রাম ও পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ শক্তিশালী হয়।
“দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।”
কবি আমাদের ছেলেদের বলছেন, তারা যেন তাদের পূর্বপুরুষের সংগ্রাম ও ভালোবাসার কথা মনে রাখে।
“আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।”
কবি আমাদের পরিবারের কথা বলছেন—মা, বোন, ভাই এবং ভালোবাসার কথা। তিনি বলছেন, ভালোবাসা দিলে মা মারা যায়, কারণ দেশের জন্য যুদ্ধে যেতে হয়, পরিবারকে ছাড়তে হয়।
“আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।”কবি বলছেন, তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলছেন। কবিতাই তার কাছে সত্য, শক্তি এবং মুক্তির পথ।
“সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালোবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা।”
কবি বলছেন, কবিতা হলো সশস্ত্র সুন্দরের অভ্যুত্থান এবং ভালোবাসার সুকণ্ঠ সংগীত। অর্থাৎ, কবিতার মাধ্যমে মানুষ সত্য ও সুন্দরকে প্রকাশ করতে পারে।
“জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।”
কবি বলছেন, মুক্ত শব্দ এবং প্রতিরোধের উচ্চারণই হলো কবিতা। অর্থাৎ, কবিতার মাধ্যমে মানুষ তার মুক্তি ও সংগ্রামের কথা বলতে পারে।
“আমরা কি তাঁর মতো কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।”
কবি শেষ করছেন একটি প্রশ্ন দিয়ে। তিনি প্রশ্ন করছেন, আমরা কি তার পূর্বপুরুষের মতো কবিতার কথা বলতে পারব? আমরা কি তার মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারব?

Related Posts

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top