আসমানী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

আসমানী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

জসীমউদ্দীনের কবিতা ‘আসমানি’ বাস্তব জীবনের করুণ চিত্র তুলে ধরেছে। আসমানি নামের একটি দরিদ্র মেয়ের দুঃখ-দুর্দশা এবং বঞ্চনার জীবনের কাহিনী এই কবিতায় উঠে এসেছে। নিচে আসমানী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন দেওয়া হল।

আসমানী কবিতার মূলভাব

আসমানি নামের ছোট্ট মেয়েটি খুবই গরিব। তার বাড়ি এত ভাঙাচোরা যে, সামান্য বৃষ্টি হলেই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ঠিকমতো খেতে না পাওয়ার কারণে তার শরীর দুর্বল হয়ে গেছে, আর অভাব-অনটনের কারণে তার মুখে হাসি নেই। সে ছেঁড়া পোশাক পরে, যা তার দারিদ্র্যকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তার বাড়ির পাশের পুকুরটি ভরা শ্যাওলা আর ম্যালেরিয়ার মশায়। সেখান থেকে দূষিত পানি তুলে রান্না আর খাওয়া হয়। এই অনাহার, রোগ আর কষ্টের মধ্যে আসমানির জীবন চলে, যেন ছোটবেলা থেকেই তাকে শুধু দুঃখ আর কষ্ট সঙ্গী করেছে। কবি এই গল্পের মাধ্যমে আসমানির মতো হাজারো দরিদ্র শিশুর দুঃখ-দুর্দশার কথা আমাদের জানিয়েছেন। তিনি আমাদের এই বঞ্চিত মানুষদের প্রতি দয়া এবং সহানুভূতি দেখাতে বলেছেন, যাতে আমরা তাদের জীবনের কষ্ট কমানোর চেষ্টা করতে পারি।

আসমানী কবিতার ব্যাখ্যা

লাইনব্যাখ্যা
আসমানিরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
কবি পাঠকদের বলে দিচ্ছেন, যদি আসমানি (এবং তার দুঃখ-দুর্দশা) দেখতে চাও, তাহলে রসুলপুর নামের গ্রামে যাও, যেখানে তার ছোট্ট গরিব বাড়ি রয়েছে। এখানে “রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি” বলতে কবি আসমানির বাড়ি বোঝাচ্ছেন।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসাভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
আসমানির বাড়ি এতটাই ভঙ্গুর এবং দুর্বল যে এটি পাখির বাসার মতো। পাখির বাসা যেমন পাতার ছানি দিয়ে তৈরি হয়, তেমনই আসমানির বাড়িও এত হালকা যে সামান্য বৃষ্টিতেই তার ছাদের মধ্যে পানি পড়ে যায়। এটি তার দরিদ্রতার এবং তার অসহায় জীবনের চিত্র।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানিরা থাকে বছর ভরে।
আসমানির বাড়ি এতটাই দুর্বল যে সামান্য হাওয়াতেই তার ঘর নড়বড়ে হয়ে যায়। তার ভেতরে থাকে আসমানি ও তার পরিবার। তারা এই নড়বড়ে, অস্থায়ী বাড়িতে বছরের পর বছর বেঁচে থাকে। এই লাইনে কবি আসমানির অসহায়তার গভীরতা তুলে ধরেছেন।
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক’খান হাড়,
সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার।
আসমানির পেট পূর্ণ হয় না, অর্থাৎ সে ঠিকমতো খেতে পায় না। তার শরীর এতটাই দুর্বল যে বুকের হাড় স্পষ্ট দেখা যায়। এটি তার দীর্ঘদিনের অনাহারের চিহ্ন। কবি আসমানির শারীরিক দুর্বলতা এবং অভাবের কষ্ট বর্ণনা করছেন।
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি,
থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।
আসমানির মুখ মিষ্টি ছিল, তবে এখন তার মুখে কোনো হাসি নেই। কষ্টের এবং অভাবের কারণে তার মুখের হাসি নিভে গেছে। কবি বলেছেন, ‘হাসির প্রদীপ-রাশি’ অর্থাৎ তার মুখে যে হাসি ছিল তা এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। অভাবের যন্ত্রণায় সে হাসতে পারছে না।
পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালি তার গার বরনের করছে উপহাস।
আসমানির পোশাক ছেঁড়া এবং পুরোনো, তার পোশাকের অবস্থাও খুব খারাপ। এখানে ‘শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস’ বলতে তার জামার ফাটা অংশ বোঝানো হয়েছে। কবি তার পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করে সমাজের উপহাসের কথা তুলে ধরছেন। আসমানির গায়ের সোনালি রঙের সৌন্দর্য তার পোশাকের অবস্থা ঢেকে রাখতে পারে না।
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।
আসমানির বড় বড় কালো চোখ ছিল, যেগুলো কখনো হাসিতে ভরা থাকত। কিন্তু এখন তার চোখে কোনো আনন্দ বা হাসি নেই, বরং সেখানে অশ্রু (কান্নার পানি) গড়িয়ে পড়ছে। এটি তার মনোভাবের পরিবর্তন এবং তার জীবনযুদ্ধের অভিব্যক্তি।
বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,
হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।
আসমানির কণ্ঠে ছিল বাঁশির মতো মধুর সুর, কিন্তু কষ্টের কারণে সেই সুর আর শোনা যায় না। তার সুর এখন ক্ষয়প্রাপ্ত, এবং তার জীবনের দুঃখের কারণে সে গান গাইতে পারে না। তার কণ্ঠস্বর যে কখনো মিষ্টি সুরে গান গাইত, তা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। কবি আসমানির জীবনের আনন্দহীনতা এবং দুঃখের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
আসমানিদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে,
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে।
আসমানির বাড়ির পাশের পদ্ম পুকুরে শ্যাওলা এবং ম্যালেরিয়া সংক্রমিত পানি জমে থাকে। সেখানে ব্যাঙের ছানা বাচ্চা তোলে, এবং শ্যাওলা-পানায় ভরা ওই পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর এবং নোংরা। এটি আসমানির জীবনযাত্রার অসম্পূর্ণতা এবং গরিবির অবস্থা তুলে ধরছে।
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানিদের চলে।
এই পুকুরের জল ম্যালেরিয়ার মশায় ভর্তি। সেই বিষাক্ত জলই আসমানি এবং তার পরিবার রান্না করার জন্য ব্যবহার করে। এখানে কবি দেখিয়েছেন যে, আসমানির পরিবার এত গরিব যে তারা রোগাক্রান্ত পানি খেতেও বাধ্য।
পেটটি তাহার ফুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।
আসমানির পেট ফুলে গেছে, সম্ভবত অপুষ্টির কারণে এবং সে খুবই অসুস্থ। তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ দুর্বল হয়ে গেছে। সে জ্বরে ভুগছে, কিন্তু তার পরিবার এত গরিব যে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পয়সা নেই। এভাবেই আসমানির পরিবার চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছে।

Related Posts

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top