প্রত্যাবর্তনের লজ্জা কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

“প্রত্যাবর্তনের লজ্জা” কবিতাটির মাধ্যমে আল মাহমুদ শহরের জীবন ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যে একটি তীব্র বৈপরীত্য তুলে ধরেছেন। কবি শহরে যাওয়ার শেষ ট্রেন ধরতে স্টেশনে পৌঁছালেও তা ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে একটি ব্যর্থতা এবং হতাশার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। মুূলভাব সহজে বুঝার জন্য প্রত্যাবর্তনের লজ্জা কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন করে দিলাম।

প্রত্যাবর্তনের লজ্জা কবিতার ব্যাখ্যা

পঙক্তিব্যাখ্যা
“শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি”এখানে কবি ট্রেন ধরার জন্য দেরি না হয়ে যায়, সেজন্য তাড়াহুড়া করে স্টেশনে পৌঁছাতে ছুটছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল শেষ ট্রেনটি ধরার জন্য, কিন্তু অবশেষে পৌঁছানোর পর তিনি হতাশ হন।
“নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ”এই লাইনটি ট্রেনের সংকেত, যা হয়তো ট্রেনটি চলে যাওয়ার সংকেত। নীল আলো সাধারণত ট্রেনের ছাড়ার সংকেত হয়, যা কবির জন্য হতাশার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।”এখানে ট্রেনের হুইসেল, তার চলন্ত ট্রেনের চিহ্ন, কবির জন্য গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরাজয়ের চিত্র তুলে ধরে। এটি এমন একটি মুহূর্ত যখন তিনি বুঝতে পারেন, ট্রেনটি চলে গেছে।
“যাদের সাথে, শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।”কবি দেখতে পাচ্ছেন, যাদের সাথে তিনি শহরে যেতে চেয়েছিলেন, তারা জানালায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন এবং উৎকণ্ঠিত। তারা ট্রেন চলে যাওয়ার পর তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, যা কবির ব্যর্থতার অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তোলে।
“আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি ।”এখানে কবি তাঁর বাবার কথা স্মরণ করছেন, যিনি তাকে সময়মত ট্রেন ধরতে তাড়াহুড়া করতে বলেছিলেন। তাঁর বাবা আশা করেছিলেন, শেষ মুহূর্তে হয়তো তিনি ট্রেনটি ধরবেন।
“আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক, কত রাত তো অমনি থাকিস I”মায়ের কথা স্মরণ করা হচ্ছে, যিনি বলেছিলেন, যদি ট্রেন মিসও হয়, তবুও মেনে নিয়ে বই পড়তে বসে থাক। মায়ের কথায় স্বস্তি এবং তার সহানুভূতির প্রকাশ রয়েছে।
“আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি নিহত হয়ে থাকলাম ।”এখানে কবি জানান, তিনি হতাশা ও পরাজয়ের মধ্যে এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় চলে যান। তিনি কোনো আশার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে স্বপ্নহীনভাবে বিছানায় শুয়ে থাকেন।
“অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়।”এখানে কবি নিজের ব্যর্থতা নিয়ে ভাবছেন। তিনি জানেন, তাঁর মতো মানুষরা (যেমন জাহানারা, ফরহাদ) কখনও ট্রেন মিস করে না। ফরহাদ স্টেশনে সময়মতো পৌঁছায়, যা কবির মধ্যে এক ধরনের গ্লানির অনুভূতি তৈরি করে।
“লাইলী মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না ।”এখানে আরো কয়েকজন চরিত্রের উল্লেখ, যারা সতর্ক এবং প্রস্তুত। লাইলী তার মালপত্রও আগে থেকেই গুছিয়ে রাখে, নাহারও কোথাও যাওয়ার আগে এমন প্রস্তুতি নেয়, যা কবির অব্যবস্থাপনা এবং অমনোযোগিতার চেয়ে অনেক ভালো।
“আর আমি এদের ভাই সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি ।”কবি তার ব্যর্থতা উপলব্ধি করেন। তিনি ৭ মাইল হেঁটে শেষ ট্রেন ধরতে গিয়ে, কুয়াশার মধ্যে এক অখ্যাত স্টেশনে হারিয়ে গেছেন। এটি তার পরাজয়ের দৃশ্য।
“কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।”এখানে কুয়াশার পর্দার মতো অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা এবং বাড়ির দিকে ফেরার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। কুয়াশার মধ্যে বেরিয়ে এসে ফিরে আসার রূপক এঁকেছেন কবি।
“শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায় শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ লাল সূর্য উঠে আসবে।”কবি শীতের শিশিরে ভিজে যাওয়া এবং সূর্যের আলো উদয়ের মাধ্যমে নতুন দিনের শুরু দেখছেন। এটি প্রতীকীভাবে তার জীবনে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা পুনর্জন্মের মতো।
“পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানো ছিটানো ঘরবাড়ি, গ্রাম ।”এখানে তিনি তার পরাজয়ের অনুভূতি এবং গৃহের কাছে ফিরে আসার শান্তি দেখছেন। সূর্য উঠলে তাঁর পরিচিত পরিবেশ সামনে আসবে, যা তাকে শান্তি ও পরিতৃপ্তি দেয়।
“জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।”এখানে নদীর দিকে উড়ে যাওয়া বকের ঝাঁকের মধ্যে কবি গ্রাম্য পরিবেশের শান্তিপূর্ণ ছবি দেখতে পাচ্ছেন। তার নিজ গ্রাম, আটচালা ঘর এবং পরিবারের প্রতীক।
“কলার ছোট বাগান । দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে।”এটি গ্রামীণ পরিবেশের শান্ত ছবি। কলার বাগান, তার পাতাগুলি কাঁপছে, যা প্রকৃতির জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে।
“বৈঠকখানা থেকে আব্বা একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,”এখানে কবি মায়ের সঙ্গে ফিরে আসার পর, তাঁর বাবা নিশ্চুপভাবে তাকে দেখবেন। বাবা তার শান্তি এবং তার ফিরিয়ে আসার কথা স্বীকার করবেন।
“ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান… ।”এটি একটি ইসলামিক বাক্যাংশ, যার মানে হলো “তোমরা উভয়ে, জিন ও মানুষ, তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?” এটা ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রতীক।
“বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন। ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায় ।”এখানে কবি মা-বাবার মুখে স্বস্তি এবং আনন্দ দেখতে পাচ্ছেন। মায়ের হাসি এবং আশ্রয় তাকে শান্তি দিচ্ছে।
“হাত মুখ ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।”মায়ের আদর্শভরা পরিচর্যা, যেখানে তিনি কবিকে শান্তি এবং স্নেহের মাধ্যমে তার ব্যর্থতার পরিপূরক অনুভূতি দিচ্ছেন।
“আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলবো।”এখানে কবি মায়ের কাছে ফিরে আসার পর, তার মধ্যে জমে থাকা লজ্জা এবং পরাজয়ের অনুভূতিকে দূর করছেন। মা তার স্নেহে কবির পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলছেন।

Related Posts

Leave a Comment