রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অপরিচিতা’ গল্পটি সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত গল্প, যেখানে বিবাহ, সম্পর্ক, সামাজিক প্রত্যাশা এবং ব্যক্তিগত আবেগের জটিলতা ফুটে উঠেছে। গল্পের নায়ক অনুপম ও নায়িকা কল্যাণী। নিচে অপরিচিতা গল্পের মূলভাব ও বিষয়বস্তু দেওয়া হল।
অপরিচিতা গল্পের মূলভাব বা মূল কথা
অনুপম, সাতাশ বছর বয়সী যুবক, তার জীবনকে সাধারণ কিন্তু মূল্যবান মনে করে। সে কলেজের সব পরীক্ষা পাস করেছে এবং ছোটবেলায় তার চেহারা নিয়ে মজা করা হতো। তার বাবা গরিব থেকে ওকালতি করে ধনী হয়েছিলেন, কিন্তু টাকা ভোগ করার আগেই মারা যান। অনুপমের মামা তার জীবনে খুব প্রভাবশালী; তিনি পরিবারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং অনুপমের কোনো চিন্তা নেই। তার বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, এবং মামা চান না অনুপম ধনী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করুক। অনুপমের বন্ধু হরিশ তাকে একটি মেয়ের প্রস্তাব দেয়, যার বয়স পনেরো এবং বাবা শম্ভুনাথবাবু। মামা শম্ভুনাথবাবুর সাথে দেখা করেন এবং বিবাহের আগে মেয়ের গহনা যাচাই করতে চান। গহনাগুলো ভালো, কিন্তু শম্ভুনাথবাবু একটি এয়ারিং দেন, যা সোনার চেয়ে অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি।
অনুপমের মামা কনের গহনা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন একটি এয়ারিং নিম্নমানের, যা তাকে রাগান্বিত করে। শম্ভুনাথবাবু মামার সন্দেহের জবাব দিয়ে বলেন, তিনি তার কন্যাকে এমন লোকের হাতে দেবেন না যারা তাকে চোর ভাবে। বিবাহের আসর ভেঙে যায়, এবং বরযাত্রীরা রেগে চলে যায়। অনুপম অপমানিত বোধ করে, কিন্তু তার মনে কল্যাণীর প্রতি গভীর আকর্ষণ থেকে যায়। এক বছর পর, অনুপম এবং তার মা ট্রেন যাত্রায় কল্যাণীর সাথে দেখা করেন। কল্যাণীর মিষ্টি কণ্ঠ এবং প্রাণবন্ত আচরণ অনুপমকে মুগ্ধ করে, কিন্তু সে বিবাহ করতে অস্বীকার করে, কারণ সে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কাজ করতে চায়। অনুপম তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে, কিন্তু কল্যাণীর সিদ্ধান্ত অটল থাকে। গল্পটি শেষ হয় অনুপমের আশা এবং অপেক্ষার মধ্যে
অপরিচিতা গল্পের বিষয়বস্তু
গল্পের নায়ক (যার নাম অনুপম) তার জীবন এবং পরিবার সম্পর্কে বলছে। তার বয়স সাতাশ বছর, এবং সে মনে করে তার জীবন খুব বেশি দীর্ঘ বা বিশেষ কিছু নয়, কিন্তু তারপরও এটির একটি বিশেষ মূল্য আছে। সে তার জীবনকে একটি ফুলের সাথে তুলনা করে, যার উপর ভ্রমর বসেছে এবং সেই স্পর্শের স্মৃতি তার জীবনে একটি ফল হিসেবে রয়ে গেছে।
অনুপম কলেজের সব পরীক্ষা পাস করেছে। ছোটবেলায় তার চেহারা নিয়ে অনেকে মজা করত, কিন্তু এখন সে এটাকে হাস্যকর মনে করে। তার বাবা একসময় গরিব ছিলেন, কিন্তু ওকালতি করে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছেন। তবে তিনি সেই টাকা ভোগ করার সময় পাননি, কারণ তিনি খুব তাড়াতাড়ি মারা যান। অনুপম তার মায়ের হাতে বড় হয়েছে, যিনি গরিব পরিবার থেকে এসেছেন এবং ধনী হওয়া সত্ত্বেও সে কথা ভুলেননি।
অনুপমের মামা তার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মামা তার চেয়ে মাত্র ছয় বছরের বড়, কিন্তু তিনি পরিবারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। অনুপমের কোনো চিন্তা নেই, কারণ মামা সব ব্যবস্থা করে দেন। অনুপম নিজেকে খুব ভালোমানুষ বলে মনে করে, কারণ সে কোনো খারাপ অভ্যাস করে না এবং মায়ের কথা মেনে চলে।
অনুপমের বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তার মামা চান না যে অনুপম ধনী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করুক। তিনি চান যে মেয়েটি তাদের পরিবারে এসে বিনয়ী হয়ে থাকবে। তবে মামা টাকার ব্যাপারে খুব সচেতন, এবং তিনি চান যে মেয়ের বাবা টাকা দিতে কসুর না করুক।
অনুপমের বন্ধু হরিশ তাকে একটি মেয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়েটির বয়স পনেরো বছর, এবং তার বাবা শম্ভুনাথবাবু। শম্ভুনাথবাবু একসময় ধনী ছিলেন, কিন্তু এখন তার অবস্থা তেমন ভালো নয়। তিনি তার মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজছেন।
অনুপমের মামা শম্ভুনাথবাবুর সাথে দেখা করেন এবং বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। মামা চান যে বিবাহের আগেই মেয়ের গহনা যাচাই করে নেওয়া হোক, যাতে কোনো ফাঁকি না থাকে। শম্ভুনাথবাবু মেয়ের গহনা নিয়ে আসেন, এবং সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়। গহনাগুলো ভালো এবং মূল্যবান, কিন্তু শম্ভুনাথবাবু একটি এয়ারিং বাদ দেন, যা আসলে সোনার চেয়ে অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি। এই এয়ারিং দিয়েই তারা কন্যাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। মামা খুব রেগে যান, কারণ তিনি মনে করেন যে শম্ভুনাথবাবু (কনের বাবা) তাকে ঠকানোর চেষ্টা করছেন। মামা খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং অনুপমকে সভায় ফিরে যেতে বলেন।
শম্ভুনাথবাবু মামার রাগের প্রতি খুব শান্ত ও স্থিরভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি মামাকে বলেন যে এখন সভায় যাওয়ার দরকার নেই, বরং আগে সবাইকে খাওয়ানো হোক। মামা প্রথমে আপত্তি করেন, কিন্তু শম্ভুনাথবাবুর শান্ত ও দৃঢ় আচরণের কাছে তিনি নতি স্বীকার করেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে শম্ভুনাথবাবু অনুপমকে খেতে বলেন। কিন্তু মামা আপত্তি করেন, কারণ তিনি মনে করেন যে বিবাহের আগে বর (অনুপম) খেতে পারে না। শম্ভুনাথবাবু মামার কথাকে উপেক্ষা করে অনুপমকে খেতে বলেন। অনুপম মামার বিরুদ্ধে যেতে পারেন না, তাই তিনি খেতে বসেন না।
শম্ভুনাথবাবু মামাকে সরাসরি বলেন যে তিনি তার কন্যাকে এমন লোকের হাতে দিতে পারবেন না, যারা মনে করে যে তিনি গহনা চুরি করবেন। তিনি মামার সন্দেহ এবং অভদ্র আচরণকে প্রত্যাখ্যান করেন। শম্ভুনাথবাবুর এই কথায় মামা খুবই অবাক হন এবং লজ্জিত বোধ করেন।
শম্ভুনাথবাবুর এই প্রতিক্রিয়ার পর বিবাহের আসর ভেঙে যায়। বরযাত্রীরা রেগে গিয়ে আসরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে এবং চলে যায়। অনুপম এবং তার পরিবার খুবই অপমানিত বোধ করে। মামা খুব রেগে যান এবং শম্ভুনাথবাবুর বিরুদ্ধে নালিশ করার কথা ভাবেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করা যায় না, কারণ শম্ভুনাথবাবু তার কন্যাকে সম্মান দিয়েছেন এবং মামার সন্দেহের জবাব দিয়েছেন।
অনুপম খুবই রেগে গিয়েছিল, কিন্তু তার মনে একটি গভীর আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই অপরিচিতা মেয়েটির (কল্যাণী) প্রতি। সে কল্পনায় দেখে যে মেয়েটি তার ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছে এবং তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। অনুপমের মনে হয় যে মেয়েটি তার ছবি লুকিয়ে রেখেছে এবং একা থাকলে তা দেখে।
এক বছর কেটে যায়। মামা আর বিবাহের কথা তুলতে পারেন না, কারণ তিনি লজ্জিত। অনুপম শুনে যে কল্যাণীর জন্য ভালো পাত্র জুটেছিল, কিন্তু সে বিবাহ করতে অস্বীকার করেছে। এই খবর শুনে অনুপমের মনে আশার আলো জ্বলে। সে কল্পনা করে যে কল্যাণী তাকে ভালোবাসে এবং তার জন্য অপেক্ষা করছে।
অনুপম এবং তার মা একটি ট্রেন যাত্রায় বের হন। ট্রেনে তারা কল্যাণীর সাথে দেখা করেন। কল্যাণীর মিষ্টি কণ্ঠস্বর এবং তার প্রাণবন্ত আচরণ অনুপমকে মুগ্ধ করে। কল্যাণী তার বাবার সাথে কানপুরে থাকে এবং সে মেয়েদের শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করেছে। অনুপম কল্যাণীর প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করে, কিন্তু কল্যাণী বিবাহ করতে অস্বীকার করে, কারণ সে মেয়েদের শিক্ষা এবং স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে চায়।