ঋতু বর্ণন কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

আলাওলের “ঋতু বর্ণন” কবিতায় বাংলার প্রকৃতির ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় রূপ তুলে ধরা হয়েছে। কবি প্রতিটি ঋতুকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং সেই ঋতুগুলো মানবজীবনে কীভাবে অনুভূতি ও আবেগ জাগায়, তা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। মুূলভাব সহজে বুঝার জন্য ঋতু বর্ণন কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন করে দিলাম।

ঋতু বর্ণন কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনলাইনের ব্যাখ্যা
প্রথমে বসন্ত ঋতু নবীন পল্লব।কবি প্রথমে বসন্তের কথা বলেছেন, যা নতুন পাতা ও ফুলের আগমনের সময়। “নবীন পল্লব” বলতে বোঝানো হয়েছে নতুন গাছপালার জন্ম এবং পরিবেশের সজীবতা।
দুই পক্ষ আগে পাছে মধ্যে সুমাধব।বসন্তের আগমনে, প্রকৃতির রূপে পরিবর্তন এসেছে এবং এর মধ্যে সুমাধব (ঋতুরাজ বসন্ত) ফুটে উঠেছে, অর্থাৎ বসন্ত এসেছে।
মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।মলয়া সমীর বলতে বোঝানো হয়েছে দক্ষিণা (স্নিগ্ধ) বাতাস, যা বসন্তকালকে সুন্দর ও সজীব করে তোলে। “কামের পদাতি” মানে হলো প্রেমের দেবতা কামদেবের দূত, যা প্রেম এবং ভালোবাসার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি।“মুকুলিত” অর্থ ফুলের কুঁড়ি, “কৈল” অর্থ গাছ। বসন্তের সময় গাছপালা ফুলে ফুলে মুকুলিত হয়ে ওঠে। “বৃক্ষ বনস্পতি” বলতে সেই গাছকে বোঝানো হয়েছে যা ফুলের পরিবর্তে ফল ধরায়।
কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।“কুসুমিত” মানে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া, “কিংশুক” হলো পলাশ ফুল বা বৃক্ষ। বসন্তে পলাশের ফুলগুলি বনভূমিতে লাল হয়ে উঠেছে।
পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল।“পুষ্পিত সুরঙ্গ” মানে ফুলে ফুলে ভরা এক সুন্দর পথ, “মল্লি” হলো বেলিফুল, “লবঙ্গ” হলো একটি সুগন্ধি মসলা ফুল, “গুলাল” হলো ফাগ বা আবির। এইসব ফুলের সুগন্ধ ও রঙ প্রকৃতিকে আরও সুন্দর করে তোলে।
ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।“ভ্রমরের ঝঙ্কার” মানে মধুমক্ষী বা ভ্রমরের গুঞ্জন, “কোকিল কলরব” মানে কোকিলের কুহুতান। বসন্তে প্রকৃতিতে এইসব শব্দের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ মিলে এক আশ্চর্য সৌন্দর্য তৈরি হয়।
শুনিতে যুবক মনে জাগে অনুভব।বসন্তের সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির এই রূপ শোনার মাধ্যমে যুবকের মনে ভালোবাসা এবং অনুভব জাগ্রত হয়।
নানা পুষ্প মালা গলে বড় হরষিত।“নানা পুষ্প মালা” মানে নানা রঙের ফুলের মালা, “গলে” মানে ঝুলে পড়া। বসন্তে ফুলের এই মালা যুবকের হৃদয়কে আনন্দিত ও হর্ষিত করে তোলে।
বিচিত্র বসন অঙ্গে চন্দন চর্চিত।বসন্তের সময় মানুষের পোশাক হতে থাকে বিচিত্র রঙের এবং গায়ে চন্দন মাখানোর রীতি চলে। এই গন্ধ ও রঙ যুবক-যুবতীর মনের আনন্দ ও প্রেমের অনুভূতি আরও জাগ্রত করে।
নিদাঘ সমএ অতি প্রচণ্ড তপন।গ্রীষ্মের সময়, যখন প্রচণ্ড গরম ও তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তখন প্রকৃতির মধ্যে তাপের প্রভাব অত্যধিক হয়।
রৌদ্র ত্রাসে রহে ছায়া চরণে সরণ।গ্রীষ্মের তাপ থেকে বাঁচতে মানুষ ছায়ায় আশ্রয় নেয়, “ছায়া চরণে সরণ” মানে ছায়ার তলায় আশ্রয় নেওয়া।
চন্দন চম্পক মাল্য মলয়া পবন।গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে চন্দন এবং চম্পকের ফুলের মালা পরিধান এবং দক্ষিণা বাতাসের মৃদু শীতলতা প্রকৃতিকে একটু স্বস্তি দেয়।
সতত দম্পতি সঙ্গে ব্যাপিত মদন।গ্রীষ্মকালে কামদেব বা মদন দেবতার প্রভাব থাকে, যা দম্পতিদের প্রেমের মধ্যে প্রকাশিত হয়।
পাবন সময় ঘন ঘন গরজিত।বর্ষাকালে আকাশে মেঘ জমে এবং বৃষ্টি আসার আগেই বজ্রপাত বা গর্জন শোনা যায়।
নির্ভয়ে বরিষে জল চৌদিকে পূরিত।বর্ষাকালে অবিরত বৃষ্টি হয় এবং জল চারদিকে ভরে যায়, প্রকৃতি স্নাত হয়ে ওঠে।
ঘোর শব্দে কৈলাসে মল্লার রাগ গাত্র।বর্ষাকালে মল্লার রাগ বাজতে থাকে, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বর্ষার আবহে এক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে।
দাদুরী শিখীনি রব অতি মন ভাএ।বর্ষাকালে মাদি ব্যাঙ বা দাদুরীর ডাক এবং ময়ূরের ঝনঝনানি শোনা যায়। এই শব্দগুলি মানুষের মনকে আনন্দিত করে।
কীটকুল রব পুনি ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে।বর্ষাকালে কীটপতঙ্গদের গুঞ্জন এবং ঝঙ্কারের শব্দ প্রকৃতির জীবন্ততার সাক্ষ্য দেয়।
শুনিতে যুবক চিত্ত হরষিত ডরে।এই সুর ও শব্দগুলি যুবকের হৃদয়কে আনন্দিত করে, তার মন ভালোবাসায় উদ্বেলিত হয়।
আইল শারদ ঋতু নির্মল আকাশে।শরৎকাল আসে এবং আকাশ পরিষ্কার ও নির্মল হয়ে ওঠে।
দোলাএ চামর কেশ কুসুম বিকাশে।শরৎকালে বাতাসে চামর দোলার মতো আর চন্দন ফুলের সৌন্দর্য বেড়ে ওঠে।
নবীন খঞ্জন দেখি বড়হি কৌতুক।শরতে খঞ্জন পাখির কৌতুকপূর্ণ নাচ দেখতে পাওয়া যায়, যা দৃশ্যটি বেশ আকর্ষণীয় হয়।
উপজিত যামিনী দম্পতি মনে সুখ।শরতের সন্ধ্যায় দম্পতিদের মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে এবং তারা একে অপরের সাথে সুখে থাকে।
প্রবেশে হেমন্ত ঋতু শীত অতি যায়।হেমন্তকালে শীত আসার আগের সময়টিতে প্রকৃতিতে এক শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
পুষ্প তুল্য তাম্বুল অধিক সুখ হয়।শীতকাল আসে, তাম্বুল বা পানের সাথে সুখ বাড়ে।
শীতের তরাসে রবি তুরিতে লুকাএ।শীতের তীব্রতায় সূর্য দ্রুত অস্ত যায় এবং দিন অল্প সময়ের জন্য থাকে।
অতি দীর্ঘ সুখ নিশি পলকে পোহাএ।শীতের রাতে রাতটি দীর্ঘ হয়, কিন্তু খুব দ্রুত সকাল হয়ে ওঠে, সবকিছু শীতের আনন্দে ভরে ওঠে।
পুষ্প শয্যা ভেদ ভুলি বিচিত্র বসন।শীতের রাতে পুষ্পের শয্যা ভেদ করে বিচিত্র বসন পরিধান করা হয়, শীতের ত্রাসের মধ্যে এক নতুন সৌন্দর্য তৈরি হয়।
উরে উরে এক হৈলে শীত নিবারণ।শীত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ বা প্রকৃতি শীতকালের প্রতিরোধে প্রাকৃতিকভাবে গতি আনতে চেষ্টা করে।
কাফুর কস্তুরী চুয়া যাবক সৌরভ।শীতকালে সুগন্ধি চুয়া, কাফুর এবং কস্তুরীর সৌরভ মিশে এক প্রশান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।
দম্পতির চিত্তেত চেতন অনুভব।শীতের সৌন্দর্য এবং তার স্নিগ্ধতার মধ্যে দম্পতির মনে এক নতুন অনুভূতি এবং চেতনা সৃষ্টি হয়।

Related Posts

Leave a Comment