আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘একুশের গান’ কবিতাটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা। এই কবিতায় কবি ভাষা আন্দোলনের বেদনা, সংগ্রাম এবং বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের কথা বলেছেন। নিচে একুশের গান কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।
একুশের গান কবিতার মূলভাব
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘একুশের গান’ কবিতাটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা। এই কবিতায় কবি বলছেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার জন্য অনেক তরুণ-তরুণী প্রাণ দিয়েছেন। তাদের রক্তে এই দিনটি রঞ্জিত হয়েছে। কবি বলেন, এই আত্মত্যাগ ও মায়েদের কান্না আমরা কখনো ভুলতে পারব না। কবি সবাইকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়ের কথা বলেন, যারা বাংলা ভাষার দাবিকে রোধ করতে গুলি চালিয়েছিল। কবি বলছেন, শোষকরা এই দেশের নয়, তারা শুধু নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করে। তিনি চান, সবাই জেগে উঠুক এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করুক। কবিতার শেষে কবি বলেন, শহিদদের আত্মা আমাদের জাগ্রত হতে বলছে। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
একুশের গান কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?” | একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের রক্তে এই দিনটি রঞ্জিত হয়েছে। কবি বলছেন, এই আত্মত্যাগ তিনি কখনো ভুলতে পারবেন না। এটি ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে বলা হয়েছে। |
“ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?” | ভাষা আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের মায়েরা কেঁদেছেন। তাদের অশ্রু দিয়ে এই ফেব্রুয়ারি মাস গড়ে উঠেছে। কবি বলছেন, এই বেদনাও তিনি ভুলতে পারবেন না। |
“আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?” | এই লাইনে কবি বলছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু একটি দিন নয়, এটি আমাদের প্রিয় দেশের (বাংলাদেশের) ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়। শহিদদের রক্তে এই দিনটি রঞ্জিত হয়েছে, এবং এটি আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল থাকবে। |
“জাগো নাগিনীরা জাগো, নাগিনীরা জাগো কালবোশেখিরা!” | কবি সবাইকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। ‘নাগিনী’ এবং ‘কালবোশেখি’ প্রকৃতির শক্তি, যা ঝড় ও পরিবর্তনের প্রতীক। কবি চাইছেন, সবাই জেগে উঠুক এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক। |
“শিশুহত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা (পৃথিবী)।” | পাকিস্তানি শাসকরা নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছিল। কবি বলছেন, এই নিষ্ঠুরতা দেখে পৃথিবীও যেন কেঁপে উঠুক। |
“দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি।” | পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা ভাষার দাবিকে রোধ করতে চেয়েছিল। তারা নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছিল, যারা শুধু মাতৃভাষার মর্যাদা চাইছিল। |
“দিন বদলের ক্রান্তি লগনে তবু তোরা পার পাবি?” না, না, না, না, খুন-রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি ॥ | কবি প্রশ্ন করছেন, পরিবর্তনের সময় এসেছে, কিন্তু শোষকরা কি এই পরিবর্তনকে থামিয়ে দিতে পারবে? এর উত্তরে তিনি বলেন, “না, না, না, না, খুন-রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই একুশে ফেব্রুয়ারি।” অর্থাৎ, শহিদদের রক্তের বিনিময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। |
“সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে, রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে।” | কবি সেই দিনের শান্ত ও সুন্দর পরিবেশের কথা স্মরণ করছেন। সেদিন আকাশ ছিল নীল, শীতের শেষে প্রকৃতি স্নিগ্ধ ছিল, এবং চাঁদ যেন হেসে উঠেছিল। |
“পথে পথে ফোটে রজনিগন্ধা অলকানন্দা যেন, এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো ক্ষ্যাপা বুনো।” | কবি প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা করছেন। পথে পথে রজনিগন্ধা ও অলকানন্দা ফুল ফুটেছে, যা শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক। কিন্তু হঠাৎ “ঝড় এলো এক, ঝড় এলো ক্ষ্যাপা বুনো।” এখানে ‘ঝড়’ বলতে পাকিস্তানি শাসকদের হিংস্রতা ও নিপীড়নকে বোঝানো হয়েছে, যা শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। |
“সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা।” | ‘আঁধারের পশু’ বলতে পাকিস্তানি শাসক ও পুলিশকে বোঝানো হয়েছে, যারা নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছিল। কবি তাদের মুখ চেনানোর কথা বলছেন, অর্থাৎ তাদের নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। |
“তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা।” | পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি কবি মা, বোন ও ভাইয়ের চরম ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। তাদের নিষ্ঠুরতার কারণে সাধারণ মানুষের মনে তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মেছে। |
“ওরা গুলি ছোড়ে এদেশের প্রাণে, দেশের দাবিকে রোখে।” | পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা ভাষার দাবিকে রোধ করতে চেয়েছিল। তারা নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছিল, যারা শুধু মাতৃভাষার মর্যাদা চাইছিল। |
“ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই বাংলার বুকে।” | পাকিস্তানি শাসকরা বাংলার মাটিতে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে। তাদের পদাঘাত বাংলার মানুষের জন্য অপমান ও বেদনার প্রতীক। |
“ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি।” | পাকিস্তানি শাসকরা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তারা মানুষের অন্ন (খাদ্য), বস্ত্র (পোশাক) এবং শান্তি নষ্ট করেছে। |
“একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি।” | কবি বারবার একুশে ফেব্রুয়ারির কথা স্মরণ করছেন। এটি বাঙালির গৌরবের দিন, এবং এই দিনের চেতনা আমাদের মনে রাখতে হবে। |
“তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি।” | কবি সবাইকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। তিনি চান, সবাই জেগে উঠুক এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করুক। |
“আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী।” | এখনো শোষকরা নির্যাতন চালাচ্ছে। অনেক বীর ছেলে ও নারী কারাগারে মারা যাচ্ছে। কিন্তু কবি বলছেন, “আমার শহিদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে, জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি।” অর্থাৎ, শহিদদের আত্মা আমাদের জাগ্রত হতে বলছে। |
“জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে।” | কবি চান, মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তি জেগে উঠুক। হাটে, মাঠে, ঘাটে, বাঁকে—সব জায়গায় মানুষ যেন জেগে উঠে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে। |
“দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালব ফেব্রুয়ারি।” | কবি চান, একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা আবার জ্বালিয়ে তুলতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। |