কত কাল ধরে মূলভাব ও বিষয়বস্তু – আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামানের “কত কাল ধরে” প্রবন্ধে বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, বিনোদন এবং সামাজিক বৈষম্যের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। আনিসুজ্জামান তাঁর লেখায় প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য ও মানুষের জীবনযাপনের চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন। নিচে কত কাল ধরে মূলভাব ও বিষয়বস্তু – আনিসুজ্জামান দেওয়া হল।

কত কাল ধরে মূলভাব

একসময় বাংলাদেশে মানুষের জীবন সহজ ছিল। রাজা-রাজড়া ছিল না, সবাই মিলেমিশে কাজ করত। তেইশ-চব্বিশশ বছর আগে রাজা এলেন, সঙ্গে মন্ত্রী, সামন্তরা। সমাজে শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হলো। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সরল ছিল—পুরুষেরা ধুতি, মেয়েরা শাড়ি পরত। সচ্ছলরা চাদর, ওড়না ব্যবহার করত। মেয়েরা টিপ, আলতা, কাজল পরত। সোনার অলংকার শুধু বড়লোকেরাই পরত। সাধারণ লোকেরা শাঁখা, মাকড়ি পরত। খাবারে ভাত, মাছ, তরকারি, দুধ, মিষ্টি ছিল প্রিয়। শিকার, কুস্তি, সাঁতার, নাচগান ছিল বিনোদন। নৌকা ছিল যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। সাধারণ লোকেরা কাঠ-খড়ের বাড়িতে থাকত, বড়লোকেরা ইট-কাঠের বাড়ি বানাত। রাজাদের সময় শেষ, কিন্তু আজও সমাজে দুটি চিত্র—সমৃদ্ধি আর দারিদ্র্য। সরু চালের ভাত, গাওয়া ঘি অনেকের স্বপ্ন। এই হলো সেই সময়ের গল্প, যখন রাজাদের আগমনে সব বদলে গেল।

কত কাল ধরে গল্পের বিষয়বস্তু

একসময় বাংলাদেশে মানুষের জীবন খুব সহজ ছিল। তখন রাজা-রাজড়া ছিল না। সবাই মিলেমিশে কাজ করত, চাষাবাদ করত, ঘর বানাত, দেশ চালাত। মানুষের দাম ছিল বেশি। কিন্তু তেইশ-চব্বিশশ বছর আগে রাজা এলেন এই দেশে। তার সঙ্গে এলেন মন্ত্রী, সামন্ত-মহাসামন্তের দল। তখন থেকে সমাজে পরিবর্তন আসতে শুরু করল। রাজা-প্রজার ব্যবধান তৈরি হলো। রাজাদের নাম ইতিহাসে বড় অক্ষরে লেখা হলো, আর সাধারণ মানুষ পেছনে পড়ে রইল।

সেই সময়ের মানুষের জীবনযাত্রা খুব সরল ছিল। পুরুষেরা ধুতি পরত, মেয়েরা শাড়ি। ধুতির সঙ্গে চাদর, শাড়ির সঙ্গে ওড়না ব্যবহার করত সচ্ছল পরিবারের লোকেরা। মেয়েরা ঘোমটা দিত, আঁচল টেনে বা ওড়না দিয়ে। তখনকার পোশাক ছোট বহরের হতো, নকশা কাটা থাকত। মেয়েরা মখমলের কাপড় পরত। সাধারণ লোকেরা কাঠের খড়ম পরত, শুধু যোদ্ধা বা পাহারাদাররা জুতো ব্যবহার করত। ছাতা-লাঠির চলও ছিল।

সাজসজ্জার দিকে তখনকার মানুষের ঝোঁক ছিল। ছেলেরা বাবরি চুল রাখত বা চুল চুড়ো করে বাঁধত। মেয়েরা খোঁপা বাঁধত, কপালে টিপ দিত, পায়ে আলতা, চোখে কাজল পরত। অলংকারের ব্যবহারও ছিল। সোনার অলংকার শুধু বড়লোকেরাই পরত। সাধারণ পরিবারের মেয়েরা শাঁখা, কচি কলাপাতার মাকড়ি পরত।

খাবারের দিক থেকে ভাত ছিল বাঙালির প্রধান খাদ্য। সরু সাদা চালের গরম ভাত, গাওয়া ঘি, নালিতা শাক, মৌরলা মাছ আর দুধ ছিল প্রিয় খাবার। লাউ, বেগুনের মতো তরকারি প্রচুর খাওয়া হতো। মাছ, বিশেষ করে ইলিশ, ছিল খুব প্রিয়। ছাগলের মাংস, হরিণের মাংস, পাখির মাংসও খাওয়া হতো। ক্ষীর, দই, পায়েস, ছানা ছিল নিত্যপ্রিয়। আম, কাঁঠাল, তাল, নারকেল ছিল প্রিয় ফল। মোয়া, নাড়ু, পিঠেপুলি, বাতাসা, কদমার মতো মিষ্টিও খুব পছন্দের ছিল।

সেই সময়ের মানুষ শিকার করতে ভালোবাসত। কুস্তি খেলা, সাঁতার কাটা, বাগান করা ছিল তাদের নিয়মিত কাজ। মেয়েরা কড়ির খেলা খেলত, ছেলেরা দাবা আর পাশা খেলত। বড়লোকেরা ঘোড়া আর হাতির খেলা দেখত। সাধারণ লোকেরা ভেড়ার লড়াই, মোরগ-মুরগির লড়াই বাঁধিয়ে দিত। নাচগান, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও ছিল। যাতায়াতের জন্য নৌকা ছিল প্রধান মাধ্যম। বড়লোকেরা হাতি, ঘোড়া-গাড়ি, পালকি ব্যবহার করত। সাধারণ লোকেরা গরুর গাড়ি বা ডুলি ব্যবহার করত।

বেশির ভাগ লোক কাঠ, খড়, মাটি, বাঁশের বাড়িতে থাকত। শুধু বড়লোকেরা ইট-কাঠের বাড়ি বানাত। তখনকার সমাজে সবাই সমান ছিল না। রাজা এসে সমাজে বিভাজন তৈরি করলেন। কেউ প্রভু, কেউ ভৃত্য হয়ে গেল। দুজন প্রাচীন কবির লেখায় দুটি ভিন্ন ছবি পাওয়া যায়—একজনের লেখায় মেয়েদের সাজসজ্জা, অলংকারের বর্ণনা, আরেকজনের লেখায় দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অভাবের চিত্র।

রাজাদের সময় এখন শেষ। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, পাঠান, মুঘল, কোম্পানি-রানি—সবাই চলে গেছেন। কিন্তু আজও সমাজে দুটি চিত্র দেখা যায়—একদিকে সমৃদ্ধি, বিলাস, আনন্দ, অন্যদিকে দারিদ্র্য, অভাব, বেদনা। সরু চালের সাদা গরম ভাতে গাওয়া ঘি আজও অনেকের স্বপ্ন।

Related Posts

Leave a Comment