কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘কুলি-মজুর’ কবিতাটি শোষিত ও নির্যাতিত শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির এক অসাধারণ প্রকাশ। কবিতাটি সমাজের বৈষম্য, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। নিচে কুলি মজুর কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।
কুলি মজুর কবিতার মূলভাব
কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সমাজের অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কুলি-মজুরদের শ্রমেই আমাদের আধুনিক সমাজ গড়ে উঠেছে। রেলগাড়ি, জাহাজ, মোটরগাড়ি, কারখানা—সবকিছু তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল। অথচ এই শ্রমিকরাই সবসময় বঞ্চিত থাকে এবং শোষিত হয়। ধনী শ্রেণি তাদের শ্রমের ফসল ভোগ করে, কিন্তু তাদের কোনো স্বীকৃতি দেয় না।
সমাজের প্রতিটি ইট, প্রতিটি পথ শ্রমিকদের ঘাম ও রক্তে ভেজা। তাদের শ্রমেই তৈরি হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা, অথচ তাদেরই অমানবিকভাবে অবহেলা করা হয়। কবি এখানে সমাজের প্রতি একটি সতর্কবার্তা দেন, যে দিন আসছে যখন শ্রমিকরা তাদের পাওনা বুঝে নেবে এবং নিজেদের অধিকার আদায় করবে। নজরুল শ্রমজীবী মানুষদের প্রকৃত দেবতা হিসেবে অভিহিত করেন। তাদেরই দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে নতুন দিনের সূচনা হবে, যেখানে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
কুলি মজুর কবিতার ব্যাখ্যা
লাইন | ব্যাখ্যা |
---|---|
দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে! | এখানে কবি বর্ণনা করছেন একটি ঘটনার, যেখানে একজন বাবু (উচ্চবিত্ত ব্যক্তি) একজন কুলিকে (শ্রমিক) ঠেলে ফেলে দিলেন। এটি একটি দুঃখজনক এবং অবমাননাকর দৃশ্য, যা শ্রমিকদের প্রতি অবজ্ঞা এবং অমানবিক আচরণকে তুলে ধরে। |
চোখ ফেটে এল জল, এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? | এই লাইনটি শ্রমিকদের প্রতি কবির সহানুভূতির প্রকাশ। তিনি প্রশ্ন তুলছেন, পৃথিবীতে কি দুর্বল এবং দরিদ্র মানুষরা এভাবেই নির্যাতিত হবে? তাদের প্রতি যে অবিচার হচ্ছে, তা কবির হৃদয় ভেঙে দেয়। |
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সাব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে। | এখানে কবি শ্রমিকদের দধীচি মুনির সঙ্গে তুলনা করেছেন, যিনি দেবতাদের জন্য নিজের অস্থি দান করেছিলেন। শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমে রেলগাড়ি চলে, কিন্তু উচ্চবিত্তরা তার সুবিধা নেয়, আর শ্রমিকরা অবহেলিত হয়। |
বেতন দিয়াছ? -চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল। | কবি এখানে মালিকপক্ষকে জিজ্ঞাসা করছেন, তারা কি যথাযথ বেতন দিচ্ছে? তিনি মালিকদের মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করছেন, কারণ তারা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। |
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে, রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে। | এই অংশে কবি উল্লেখ করছেন যে, শ্রমিকদের পরিশ্রমেই দেশের সব উন্নয়ন—মোটর, জাহাজ, রেলগাড়ি, এবং কলকারখানা সম্ভব হয়েছে। |
বল তো এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা। | কবি প্রশ্ন করছেন, এই সব উন্নয়ন এবং অট্টালিকা কার পরিশ্রমে হয়েছে? তিনি বলছেন, প্রতিটি ইটের গায়ে শ্রমিকদের রক্তের দাগ আছে। |
তুমি জান নাকো, কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে! | শ্রমিকদের পরিশ্রমের মূল্য বুঝতে না পারলেও, পথের ধূলিকণাও জানে কিভাবে এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। |
আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ | কবি আশা প্রকাশ করছেন যে, একদিন ন্যায়বিচার আসবে এবং মালিকদের শ্রমিকদের ঋণ শোধ করতে হবে। |
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়, পাহাড়-কাটা সে পথের দু-পাশে পড়িয়া যাদের হাড়। | এই অংশে কবি শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের কথা বলছেন, যারা পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করেছে এবং তাদের হাড় সেই পথের পাশে পড়ে আছে। |
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি, তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি; | শ্রমিকদের পরিশ্রমে যারা উন্নত জীবন যাপন করছে, তাদের প্রতি শ্রমিকদের আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। |
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান, তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান! | কবি শেষ লাইনগুলোতে শ্রমিকদের প্রশংসা করেছেন, তাদের মানুষ এবং দেবতা বলে অভিহিত করেছেন। শ্রমিকদের ব্যথিত বুকের উপর দিয়েই নতুন উত্থান বা পরিবর্তনের সূচনা হবে। |