গরবিনী মা জননী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

সিকান্দার আবু জাফরের ‘গরবিনী মা-জননী’ কবিতাটি গভীর দেশপ্রেম ও মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধা-নিবেদনের এক অনবদ্য নিদর্শন। ‘গরবিনী মা-জননী’ মূলত বাংলার মাটি, প্রকৃতি, মানুষ, সংগ্রাম এবং তার রক্তস্নাত গৌরবের কথা বলে। নিচে গরবিনী মা জননী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন দেওয়া হল।

গরবিনী মা জননী কবিতার মূলভাব

বাংলাকে এখানে মায়ের রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই মা খুব গর্বিত, কারণ তার সন্তানেরা তাকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। বাংলার মাটির মতোই মায়ের আঁচল সবুজে ভরা, নদীর মতো তার চোখে কাজল, আর ধুলোর নূপুর তার পায়ে বাজে। এই মায়ের সন্তানরা হলো কৃষক, জেলে, কামার, কুমোর—যারা প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে। কিন্তু যখন অন্যায় বা অত্যাচার আসে, তখন তারাই মায়ের সম্মান রক্ষার জন্য লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এই সন্তানরা অনেক কষ্ট সহ্য করে, জেল, জুলুম, এমনকি ফাঁসির দড়ি পর্যন্ত মাথা পেতে নেয়। কিন্তু তারা মায়ের মান-সম্মান কোনোদিন বিক্রি হতে দেয় না। মা-ও তাদের সাহস জোগায়, লড়াইয়ে শক্তি দেয়। এভাবেই মা ও সন্তানের সম্পর্ক এক অনন্য গর্বের গল্প হয়ে ওঠে। মূলত, কবিতাটি বাংলার মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সংগ্রামী চেতনার গভীর সংযোগের কথা বলে। এটি আমাদের স্মরণ করায় যে, বাংলার এই সাহসী মানুষই যুগে যুগে দেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষা করেছে।

গরবিনী মা জননী কবিতার ব্যাখ্যা

লাইনব্যাখ্যা
ওরে আমার মা-জননী
জন্মভূমি বাঙলারে
তোর মত আর পুণ্যবতী
ভাগ্যবতী বল মা কে।
এই লাইনগুলোতে কবি বাংলাকে নিজের মা হিসেবে কল্পনা করেছেন। তিনি বলছেন, এই দেশমাতার মতো এত পবিত্র (পুণ্যবতী) আর সৌভাগ্যবতী মা আর কোথাও নেই। কারণ এই মাটি যেমন ভালোবাসা আর আশ্রয় দেয়, তেমনি এর গর্বিত সন্তানরা নিজেদের জীবন দিয়ে এর মর্যাদা রক্ষা করে।
কার চোখে মা নদীর কাজল
সবুজ তৃণের আঁচল বুকে
কার পায়ে মা ধুলোর নূপুর
সন্ধ্যা দুপুর বেজেই চলে।
এখানে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশকে তুলে ধরা হয়েছে। মায়ের চোখে নদীর কাজল মানে বাংলার নদ-নদীর মিষ্টি সৌন্দর্য। সবুজ তৃণের আঁচল মায়ের শাড়ির আঁচলের মতো পুরো দেশকে ঢেকে রেখেছে। আর ধুলোর নূপুর শব্দের মাধ্যমে বাংলার গ্রাম্য পরিবেশ, যেখানে মাটির ধুলোই যেন মায়ের সাজ। এই দৃশ্য বাংলার সকাল, দুপুর, সন্ধ্যার প্রতিদিনের জীবনকে প্রতিফলিত করে।
রোজ ভোরে কে শিশির খোঁপায়
বকুল যুঁথীর গন্ধ মাখে
কার দুপুরের তন্দ্রা ভেজে
ক্লান্ত ঘুঘুর বিলাপ-জলে।
এই অংশে বাংলার মাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। ভোরবেলায় শিশির মায়ের খোঁপায় বকুল আর যুঁথির ফুলের মতো সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। দুপুরের ক্লান্তি যেন ঘুঘুর করুণ ডাকে প্রকাশ পায়। বাংলার প্রকৃতি যেন মায়ের রূপ ও গন্ধের প্রতিচ্ছবি।
কামার কুমোর জেলে চাষী
বাউল মাঝি ঘর-উদাসী,
কার ছেলেরা নিত্য হাজার
মরণ-মারের দণ্ড গোনে।
এখানে মায়ের সন্তানদের কথা বলা হয়েছে। কামার, কুমোর, জেলে, চাষি, বাউল, মাঝি—এরা সবাই বাংলার প্রকৃত সন্তান, যারা পরিশ্রম করে দেশকে গড়ে তোলে। তাদের জীবন কঠিন, কারণ তারা প্রতিদিন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। অনেক সময় তারা অন্যায়ের শিকার হয়, মরণ কিংবা শাস্তির মুখোমুখি দাঁড়ায়, তবু তারা কখনো মাথা নত করে না।
ছেলের বুকের খুন ছোপানো
কোন্ জননীর আঁচল-কোণে
দুর্ভাগিনী কার মেয়েরা
কান্নাফুলের নকশা বোনে।
বাংলার সন্তানেরা মায়ের জন্য নিজের রক্ত ঢেলে দেয়। তাদের বুকের রক্ত মায়ের আঁচলে লেগে থাকে। এই লাইনগুলোতে দেশমাতার প্রতি সন্তানদের ত্যাগের গভীরতা ফুটে উঠেছে। আবার, বাংলার মেয়েরা, যারা অনেক সময় সংগ্রামে অংশ নিতে পারে না, তারা তাদের দুঃখ, কান্না আর কষ্ট দিয়ে মায়ের জন্য নকশা বোনে। এই ‘কান্নাফুলের নকশা’ মূলত তাদের বেদনার প্রতীক।
সেই মাকে যার হাজার হাজার
মা-নাম-ডাকা পাগল ছেলে
মায়ের নামে ঝাঁপিয়ে পড়ে
ভয়ঙ্করের দুর্বিপাকে।
এখানে সেই বীর সন্তানদের কথা বলা হয়েছে, যারা মায়ের নামে সব ভয় উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা বিপদের তোয়াক্কা না করে দেশের জন্য, মায়ের সম্মানের জন্য, সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। এই মায়ের সন্তানরাই প্রকৃত অর্থে মাকে গর্বিত করে।
কার ছেলে মা উপড়ে ফ্যালে
বুলেট ফাঁসির শাসন-কারা
দুখের ধূপে সুখ পুড়িয়ে
কার ছেলে মুখ উজ্জ্বল রাখে।
বাংলার সন্তানরা অত্যাচার, শাসন কিংবা বন্দিশালা থেকে মাকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করে। তাদের সংগ্রামে কষ্ট যতই হোক, তারা বাংলার মুখ উজ্জ্বল রাখে। এই সন্তানরা দেশের জন্য নিজেদের সুখ ত্যাগ করতেও দ্বিধা করে না।
তুই তো সে-মা
ও মা তুই তো রে সেই গরবিনী
রক্তে-ধোওয়া সরোজিনী
যুগ-চেতনার চিত্তভূমি
নিত্যভুমি বাঙলারে।
এই শেষ অংশে কবি বাংলাকে গরবিনী মা হিসেবে চিত্রিত করেছেন। মায়ের গরিমা ও গর্ব মাটির রক্তস্নাত ইতিহাসে নিহিত। যুগে যুগে বাংলার মানুষ তাদের বুদ্ধি, সাহস ও সংগ্রামের মাধ্যমে এই মাটিকে মহিমান্বিত করেছে। এই মাটি শুধু জন্মভূমি নয়, এটি চেতনার কেন্দ্র, যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন ইতিহাস লেখা হয়।

Related Posts

Leave a Comment