কাজী নজরুল ইসলামের প্রকৃতিপ্রেম ও তাঁর কাব্যের সরল সৌন্দর্য এখানে দারুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতায় নজরুলের সহজ-সরল গ্রামীণ প্রকৃতি নিয়ে যে গভীর ভালোবাসা, তা প্রকৃতিপ্রেমের এক অনন্য উদাহরণ। নিচে ঝিঙে ফুল কবিতার সারমর্ম ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন দেওয়া হল।
Table of Contents
ঝিঙে ফুল কবিতার সারমর্ম বা মূলভাব
কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতায় কবি একটি সাধারণ ঝিঙে ফুলকে কেন্দ্র করে প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। ঝিঙে ফুল প্রকৃতির সাদামাটা অথচ সুন্দর এক অংশ। পৌষের সময় যখন প্রকৃতি ম্লান হয়ে যায়, তখন ঝিঙে ফুল জাফরান রঙ নিয়ে মাচায় ফুটে ওঠে, মরা প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রজাপতি ও তারা ঝিঙে ফুলকে তার শিকড় ছেড়ে আকাশে চলে আসার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ঝিঙে ফুল সেই প্রলোভনে পা না দিয়ে মাটির প্রতি ভালোবাসা জানায়। সে মাটিকেই তার মা হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মাটির কাছেই থাকতে চায়। এই কবিতার মাধ্যমে কবি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, মাটির প্রতি ভালোবাসা তুলে ধরেছেন। মাটির প্রতি এমন মমত্ববোধ কবির প্রকৃতিপ্রেমের গভীরতাকে প্রকাশ করে।
ঝিঙে ফুল কবিতার ব্যাখ্যা
লাইন | ব্যাখ্যা |
---|---|
ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল! সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল— ঝিঙে ফুল। | এই পংক্তিতে কবি ঝিঙে ফুলের কথা বলে শুরু করেছেন। তিনি ঝিঙে ফুলকে সবুজ পাতার পৃথিবীতে ফুটে থাকা এক সোনালি রঙের সুন্দর ফুল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এই রঙ যেন প্রকৃতির মাঝে জীবনের বার্তা নিয়ে আসে। “ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল” বলতে ফিঙে পাখির উপস্থিতি বোঝানো হয়েছে, যারা ঝিঙে ফুলের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। এতে প্রকৃতির সৌন্দর্যের একটি ছবি ফুটে ওঠে। |
গুলো পর্ণে লতিকার কর্ণে ঢলঢল স্বর্ণে ঝলমল দোলো দুল – ঝিঙে ফুল। | এখানে কবি বলেছেন, ঝিঙে ফুল লতাপাতার মধ্যে যেন সোনার মতো ঝলমল করছে। তার রঙ এবং দোলার দৃশ্য কবির চোখে এক অসাধারণ সৌন্দর্য এনে দেয়। এটি প্রকৃতির সাধারণ একটি ফুল হলেও তার সৌন্দর্য অনন্য। |
পাতার দেশের পাখি বাঁধা হিয়া বোঁটাতে, গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে। | ঝিঙে ফুলকে কবি এমন একটি সত্তা হিসেবে দেখিয়েছেন, যে প্রকৃতির অংশ হয়ে পাখিদের আকর্ষণ করে। পাখিরা যেন তার চারপাশে ঘুরে বেড়ায় এবং তাদের হৃদয় এই ফুলের প্রতি বাঁধা পড়ে যায়। সন্ধ্যার সময় যখন ঝিঙে ফুল ফোটে, তখন সেই দৃশ্য যেন একটি গানের মতো মধুর হয়ে ওঠে। |
পউষের বেলাশেষ, পরি জাফরানি বেশ, মরা মাচানের দেশ, করে তোলো মশগুল— ঝিঙে ফুল! | এই অংশে পউষের শেষ দিকে যখন প্রকৃতি শুষ্ক ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তখন ঝিঙে ফুল তার জাফরান রঙ নিয়ে মাচায় ফুটে ওঠে। সেই রঙ মরা মাচানকেও নতুন করে প্রাণবন্ত করে তোলে। এই ফুল যেন প্রকৃতির মধ্যে নতুন আনন্দ এনে দেয়। |
শ্যামলী মায়ের কোলে সোনামুখ খুকু রে, আলুথালু ঘুমু যাও রোদে গলা দুপুরে। | এই লাইনে ঝিঙে ফুলকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে, যেন এটি একটি ছোট্ট শিশু, যে সবুজ প্রকৃতির (শ্যামলী মায়ের) কোলে শুয়ে আছে। দুপুরের রোদের মধ্যে যেন সে আরামে ঘুমিয়ে আছে। এতে প্রকৃতির প্রতি কবির ভালোবাসা এবং স্নেহের প্রকাশ ঘটে। |
প্রজাপতি ডেকে যায়— ‘বোঁটা ছিঁড়ে চলে আয়! আসমানে তারা চায়— চলে আয় এ অকুল!’ | এই অংশে প্রজাপতি ঝিঙে ফুলকে তার বোঁটা ছেড়ে আকাশে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। তারারাও তাকে ডাকছে, যেন সে তাদের সঙ্গে আকাশে উড়ে বেড়ায়। এটি এমন একটি পরিস্থিতি বোঝায়, যেখানে ফুলকে মাটি ছেড়ে নতুন উচ্চতায় যাওয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। |
তুমি বলো—‘আমি হায় ভালোবাসি মাটি-মায়, চাই না ও অলকায়, ভালো এই পথ-ভুল!’ | কিন্তু ঝিঙে ফুল সেই ডাক উপেক্ষা করে উত্তর দেয় যে সে মাটির প্রতি ভালোবাসায় বাঁধা। সে তার শিকড়, তার জন্মভূমি মাটি ছেড়ে যেতে চায় না। আকাশে (অলোকায়) গিয়ে তার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। সে মাটির স্নেহে আর শিকড়ের টানে সন্তুষ্ট। |