শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “তিনপাহাড়ের কোলে” কবিতাটি প্রকৃতির মায়াবী ও রহস্যময় আবেশে ভরা। কবিতাটি পাঠকের মনে এক অদ্ভুত ভ্রমণের অনুভূতি জাগায়, যেখানে প্রকৃতি ও মানবিক অনুভূতির মেলবন্ধন ঘটে। নিচে তিন পাহাড়ের কোলে কবিতার বিষয়বস্তু ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।
তিন পাহাড়ের কোলে কবিতার বিষয়বস্তু
এই কবিতাটি শুরু হয় এক রাতের গল্প দিয়ে। কবি আর তাঁর দুই বন্ধু মিলে ট্রেন থেকে নেমে এক পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছান। সেখানে চারদিক অন্ধকার, শুধু আকাশ ভরা তারা। স্টেশনটা জনমানবশূন্য, চারদিকে শান্তি। এমন জায়গায় পৌঁছলে সবাই যেন একটু হারিয়ে যায়, পথ খুঁজে পায় না। কিন্তু এই হারানোটা ভালো লাগার, কারণ এখানে পথ হারালেও নতুন পথ খুঁজে পাওয়া যায়। চারদিকে শুধু প্রকৃতি—ঝরনা, পাথর, টিলা, বন। এই বনের ওপারে যেন এক স্বপ্নের জগৎ, যেখানে মন ভেসে বেড়ায়।
তারপর ধীরে ধীরে ভোর হয়। পুব আকাশে আলো ফুটতে শুরু করে, যেন নতুন বউয়ের ঘোমটা খুলছে। এই আলোয় তিন পাহাড়ের কোলে শান্ত গ্রামগুলো দেখা যায়, যেন সবুজে মোড়া। কবি ভাবেন, এত সুন্দর জায়গায় থাকলে কি আর খাঁচার মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা যায়? এই পাহাড়ি প্রকৃতি আর গ্রামের জীবন দেখলে মনে হয় শৈশবের মতো সরল, নিষ্পাপ জীবন ফিরে পাওয়া যায়।
এটা শুধু কবিতার বাহ্যিক অর্থ। ভেতরের অর্থ হলো, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেলে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, তার মন শান্ত হয়। পাহাড়ের সৌন্দর্য এবং নিস্তব্ধতা কবির মনে এক গভীর প্রশান্তি আনে, যা তাকে নিজের ভেতরের আমিকে খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
তিন পাহাড়ের কোলে কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“অন্ধকারে তিনপাহাড়ে ট্রেনের থেকে নেমে,” | কবি আর তাঁর দুই বন্ধু রাতের অন্ধকারে ট্রেন থেকে নেমে এক পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছান। এই লাইনে কবি তাদের যাত্রার শুরুটা বর্ণনা করেছেন, যেখানে অন্ধকার আর পাহাড়ের মিলন ঘটেছে। |
“হাওয়াবিলাসী তিনজোড়া চোখ আটকে গেল ফ্রেমে।” | পাহাড়ি এলাকার প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে তাদের তিনজনের চোখ যেন আটকে যায়। এই দৃশ্য যেন একটা ছবির ফ্রেমে বন্দি হয়ে গেছে। “হাওয়াবিলাসী” মানে প্রকৃতির মায়ায় মুগ্ধ হওয়া। |
“জনমানববিহীন স্টেশন, আকাশ ভরা তারায়,” | স্টেশনটা একদম ফাঁকা, চারদিকে কেউ নেই। আকাশে শুধু তারা ভরা। এই লাইনে কবি এক নিস্তব্ধ, নির্জন পরিবেশের কথা বলেছেন। |
“এমন একটি দেশে আসলে সক্কলে পথ হারায়।” | এমন জায়গায় এলে সবাই যেন একটু হারিয়ে যায়, পথ খুঁজে পায় না। এটা শুধু বাইরের পথ নয়, ভেতরের পথও হতে পারে। এই লাইনে কবি প্রকৃতির মাঝে মানবিক হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। |
“পথ হারিয়ে যায় যেদিকে, সেদিকে পথ আছেই,” | এখানে পথ হারালেও নতুন পথ খুঁজে পাওয়া যায়। এই লাইনে কবি বলেছেন, হারানো মানেই শেষ নয়, নতুন পথ সব সময় খোলা থাকে। |
“ঝরনা, কাঁদড়, টিলা, পাথর বনভূমির কাছেই।” | চারদিকে শুধু প্রকৃতি—ঝরনা, গাছ, টিলা, পাথর, বন। এই লাইনে কবি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের কথা বলেছেন, যা পাহাড়ি এলাকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। |
“বনভূমির ওপারে কোন মনোভূমির দ’য়,” | বনের ওপারে যেন এক স্বপ্নের জগৎ। এই লাইনে কবি বলেছেন, প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে আছে এক মানসিক জগৎ, যেখানে মন ভেসে বেড়ায়। |
“ফুসুর ফাসুর ঘুসুর ঘাসুর স্বপ্নে কথা হয়।” | স্বপ্নের জগতে নানা কথা হয়, যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। এই লাইনে কবি স্বপ্নের জগতের এক মায়াময় আবহ তৈরি করেছেন। |
“পুব আকাশে আস্তে-ধীরে আলোর ঘোমটা খোলে,” | ধীরে ধীরে ভোর হয়। পুব দিকের আকাশে আলো ফুটতে শুরু করে, যেন নতুন বউয়ের ঘোমটা খুলছে। এই লাইনে কবি ভোরের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। |
“শস্ত্র সবুজ গাঁ ভেসেছে তিনপাহাড়ের কোলে।” | এই আলোয় তিন পাহাড়ের কোলে সবুজ গ্রামগুলো দেখা যায়, যেন মেঘের মধ্যে ভেসে আছে। এই লাইনে কবি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। |
“সহজ করে বাঁচা কি আর খাঁচাতে সম্ভব?” | কবি ভাবেন, এত সুন্দর জায়গায় থাকলে কি আর খাঁচার মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা যায়? এই লাইনে কবি বলেছেন, প্রকৃতির মাঝে থাকলে জীবন সহজ আর সুন্দর হয়ে ওঠে। |
“তিনপাহাড়ের নকশিকাঁথায় শিশুর কলবর।” | এই পাহাড়ি প্রকৃতি আর গ্রামের জীবন দেখলে মনে হয় শৈশবের মতো সরল, নিষ্পাপ জীবন ফিরে পাওয়া যায়। এই লাইনে কবি শৈশবের স্মৃতির কথা বলেছেন। |