শামসুর রাহমানের “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা” কবিতাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা। নিচে তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা কবিতার মূলভাব
শামসুর রাহমানের “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা” কবিতাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। কবিতায় তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং স্বাধীনতার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষাকে গভীরভাবে চিত্রিত করেছেন। সাকিনা বিবি, হরিদাসী, রুস্তম শেখ, মতলব মিয়ার মতো মানুষের ত্যাগের মাধ্যমে কবি দেখিয়েছেন যে, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক জীবন হারিয়েছে, অনেক পরিবার ভেঙে গেছে। কবিতায় শহরের বুকে ট্যাঙ্কের আগমন, ছাত্রাবাস ও বস্তি উজাড় হওয়া, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছাই হওয়ার মর্মান্তিক চিত্র ফুটে উঠেছে। কবিতাটির শেষে কবি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, স্বাধীনতা আসবেই, এবং এর মাধ্যমে একটি নতুন ও সুন্দর পৃথিবীর জন্ম হবে।
তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা / আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?” | কবি স্বাধীনতাকে সম্বোধন করে বলছেন, “হে স্বাধীনতা, তোমাকে পেতে আমাদের কতবার রক্তের নদী পার হতে হবে?” এখানে ‘রক্তগঙ্গা’ শব্দটি যুদ্ধে নিহত মানুষের রক্তের প্রবাহকে বোঝায়। কবি প্রশ্ন করছেন, স্বাধীনতা পেতে গিয়ে আর কত মানুষকে প্রাণ দিতে হবে? |
“আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?” | ‘খাণ্ডবদাহন’ মহাভারতের একটি ঘটনা, যেখানে অরণ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এখানে এটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক। কবি বলছেন, স্বাধীনতা পেতে গিয়ে আর কতবার এমন ভয়াবহ ধ্বংস দেখতে হবে? |
“তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, / সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল, / সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।” | মুক্তিযুদ্ধে সাকিনা বিবি ও হরিদাসীর স্বামীরা শহিদ হয়েছেন। সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল মানে তার স্বামীর মৃত্যুর শোকে তিনি ভেঙে পড়েছেন। হরিদাসীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল মানে তিনি বিধবা হয়েছেন, কারণ সনাতন ধর্মমতে স্বামীর মৃত্যুর পর নারীরা সিঁদুর মুছে ফেলেন। |
“তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, / শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো / দানবের মতো চিৎকার করতে করতে।” | পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক শহরে প্রবেশ করল, যা দানবের মতো ভয়ঙ্কর শব্দ করে চলছে। এখানে ট্যাঙ্কের মাধ্যমে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও আতঙ্ককে বোঝানো হয়েছে। |
“তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, / ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল / আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র।” | পাকিস্তানি বাহিনী ছাত্রাবাস ও বস্তিতে হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দিল। তারা নির্বিচারে গুলি চালালো, যার ফলে সব জায়গায় মৃত্যু ও ধ্বংস ছড়িয়ে পড়ল। |
“তুমি আসবে বলে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।” | স্বাধীনতা আসবে বলে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দিল। |
“তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার / ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।” | যুদ্ধে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটি কুকুর আর্তনাদ (চিৎকার) করছে। |
“তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, / অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতা-মাতার লাশের উপর।” | যুদ্ধে পিতা-মাতা মারা যাওয়ায় একটি শিশু তাদের লাশের উপর হামাগুড়ি(গড়াগড়ি) দিচ্ছে। |
“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে / আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? / আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?” | কবি আবারও প্রশ্ন করছেন, স্বাধীনতা পেতে গিয়ে আর কত রক্ত ঝরবে? আর কত ধ্বংস দেখতে হবে? |
“স্বাধীনতা, তোমার জন্যে থুথুড়ে এক বুড়ো / উদাস দাওয়ায় বসে আছেন তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের / দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।” | একজন বৃদ্ধ স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার চোখে স্বাধীনতার প্রত্যাশা ও বেদনা মিশে আছে। তিনি দুর্বল, কিন্তু আশায় বুক বেঁধে আছেন। তার চুল বাতাসে নড়ছে, যা তার একাকীত্ব ও অপেক্ষার চিত্র তুলে ধরে। |
“স্বাধীনতা, তোমার জন্যে / মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে / নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।” | একজন বিধবা নারী তার পুড়ে যাওয়া ঘরের নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার স্বামী যুদ্ধে মারা গেছেন, এবং তার ঘরও ধ্বংস হয়েছে। |
“স্বাধীনতা, তোমার জন্যে / হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে / বসে আছে পথের ধারে।” | একটি অনাথ কিশোরী, যার শরীর হাড্ডিসার, সে শূন্য থালা হাতে পথের ধারে বসে আছে। তার পরিবার যুদ্ধে মারা গেছে, এবং সে এখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগছে। |
“তোমার জন্যে, / সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক, / কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা, / মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি, / গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে, / রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস এখন পোকার দখলে।” | কবি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন। সগীর আলী (কৃষক), কেষ্ট দাস (জেলে), মতলব মিয়া (নৌকার মাঝি), রুস্তম শেখ (রিকশাওয়ালা)—এরা সবাই যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। তাদের ত্যাগের মাধ্যমে একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে। রুস্তম শেখের ফুসফুস পোকার দখলে—এটি তার মৃত্যুর পর দেহের পচনকে বোঝায়, যা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও মানুষের ত্যাগের চিত্র তুলে ধরে। |
“আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো / সেই তেজি তরুণ যার পদভারে / একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-“ | একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, যিনি রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে। |
“সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।” | কবি বলছেন, সবাই স্বাধীনতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এই অপেক্ষা শুধু মানুষের নয়, বরং সমগ্র জাতির। |
“পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত / ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, / নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায় / তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।” | কবি বলছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে। নতুন পতাকা উড়বে, বিজয়ের ধ্বনি বাজবে। বাংলার মাটিতে স্বাধীনতা আসবেই, এবং এর মাধ্যমে একটি নতুন ও সুন্দর পৃথিবীর জন্ম হবে। |