পল্লিসাহিত্য প্রবন্ধের মূলভাব ও বিষয়বস্তু

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচিত ‘পল্লিসাহিত্য’ প্রবন্ধটি মূলত বাংলার পল্লি বা গ্রামীণ সাহিত্যের ঐতিহ্য, সৌন্দর্য এবং এর গুরুত্ব নিয়ে লেখা। নিচে পল্লিসাহিত্য প্রবন্ধের মূলভাব ও বিষয়বস্তু দেওয়া হল।

পল্লিসাহিত্য প্রবন্ধের মূলভাব

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচিত ‘পল্লিসাহিত্য’ প্রবন্ধে বাংলার গ্রামীণ সাহিত্যের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যকে তুলে ধরা হয়েছে। পল্লিসাহিত্যে রূপকথা, ছড়া, গান, প্রবাদ-প্রবচন, ডাক ও খনার বচনের মতো উপাদান রয়েছে, যা গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলে। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ পল্লিসাহিত্যের অমূল্য সম্পদকে প্রকাশ করেছে। রূপকথা ও উপকথাগুলো শুধু বাংলার নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও প্রচলিত। প্রবাদ বাক্য ও খনার বচনে জাতির পুরনো ইতিহাস ও ভূয়োদর্শনের ছাপ রয়েছে। ছড়া ও পল্লিগান যেমন জারি, ভাটিয়ালি, রাখালি গান পল্লিসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ও শহুরে সংস্কৃতির প্রভাবে এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। পল্লিসাহিত্য সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল ও সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো Folklore Society গঠন করে পল্লিসাহিত্য সংগ্রহ ও গবেষণা করা যেতে পারে। পল্লিসাহিত্য শুধু বাংলার নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও অংশ, এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে পারব।

পল্লিসাহিত্য প্রবন্ধের বিষয়বস্তু

১. পল্লিসাহিত্যের প্রাচুর্য:

গ্রামে শহরের মতো গায়ক, বাদক বা নর্তক না থাকলেও প্রকৃতির মাঝে সাহিত্যের উপকরণ ছড়িয়ে আছে। পাখির কলরব, নদীর শব্দ, পাতার মর্মর ধ্বনি এবং শস্যের হিল্লোলে পল্লিজীবন সাহিত্যময় হয়ে উঠেছে। গ্রামের ঘাটে-মাঠে, আলো-বাতাসে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে, কিন্তু আমরা তা খেয়াল করি না।


২. পল্লিসাহিত্যের উপেক্ষা:

পল্লিসাহিত্য এতটাই স্বাভাবিক ও নিত্যদিনের যে, মানুষ এর গুরুত্ব অনুভব করে না। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের মতো পণ্ডিতরা মৈমনসিংহ গীতিকার মাধ্যমে পল্লিসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ তুলে ধরেছেন। কিন্তু এখনও অনেক পল্লিকবি ও সাহিত্যিক অজানা রয়ে গেছেন। তাদের সাহিত্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করা দরকার।


৩. রূপকথা ও উপকথার গুরুত্ব:

গ্রামের বুড়ি-বুড়িরা ছেলেমেয়েদের রূপকথা শোনায়। এগুলো শুধু বাংলার নয়, সিংহল, সুমাত্রা, যাভা, কম্বোডিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও প্রচলিত। এগুলো নৃতত্ত্ব ও ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ। কিন্তু আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।


৪. প্রবাদ-প্রবচন ও ডাক-খনার বচন:

গ্রামে প্রবাদ বাক্য, ডাক ও খনার বচনে জাতির পুরনো ইতিহাস ও ভূয়োদর্শনের ছাপ রয়েছে। যেমন, “দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই” বা “ধরি মাছ না ছুঁই পানি”। এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।


৫. ছড়া ও পল্লিগান:

ছড়া এবং পল্লিগান (যেমন জারি গান, ভাটিয়ালি গান, রাখালি গান) পল্লিসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এগুলোতে প্রেম, আনন্দ, সৌন্দর্য এবং তত্ত্বজ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ও শহুরে সংস্কৃতির প্রভাবে এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।


৬. পল্লিসাহিত্যের সংরক্ষণের প্রয়োজন:

পল্লিসাহিত্য বাংলার হিন্দু-মুসলমান সকলের সাধারণ সম্পত্তি। এর সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল ও সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো Folklore Society গঠন করে পল্লিসাহিত্য সংগ্রহ ও গবেষণা করা যেতে পারে।


৭. নাগরিক সাহিত্যের পাশাপাশি পল্লিসাহিত্যের স্থান:

আধুনিক সাহিত্যে নাগরিক জীবন ও সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকলেও পল্লিজীবন ও তার সাহিত্যিক উপাদানগুলোর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। পল্লিসাহিত্যের মাধ্যমে পল্লিজীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।

এই প্রবন্ধটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পল্লিসাহিত্যের মূল্য অনেক, এবং এগুলো সংরক্ষণ ও প্রচারের মাধ্যমে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারব।

Related Posts

Leave a Comment