জসীমউদ্দীনের “প্রতিদান” কবিতাটি প্রকৃতপক্ষে মানবিকতা, ক্ষমা, এবং ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ। কবিতাটিতে কবি বলেন হিংসা ও বিদ্বেষের পরিবর্তে ভালোবাসা ও সহানুভূতি দেখাতে। নিচে প্রতিদান কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।
প্রতিদান কবিতার মূলভাব
জসীমউদ্দীনের “প্রতিদান” কবিতায় কবি বলেছেন, তিনি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন—কেউ তার ঘর ভেঙে দিয়েছে, কেউ তাকে পথ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, আবার কেউ তাকে কটু কথা বলেছে বা তার বুকে আঘাত করেছে। কিন্তু কবি এই সব আঘাত ও কষ্টের জন্য প্রতিশোধ নিতে চান না। বরং তিনি এই সব মানুষদের ক্ষমা করে দেন এবং তাদের জন্য ভালো কিছু করতে চান। তিনি বলেছেন, যে তার ঘর ভেঙে দিয়েছে, তিনি সেই মানুষের জন্য নতুন ঘর বানিয়ে দেবেন; যে তাকে পথ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, তিনি তার জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াবেন; যে তাকে কটু কথা বলেছে, তিনি তার জন্য গান গেয়ে তার হৃদয় জয় করবেন; আর যে তাকে আঘাত করেছে, তিনি তার জন্য ফুলের মালা গেঁথে দেবেন। কবি বিশ্বাস করেন, ভালোবাসা ও ক্ষমার মাধ্যমেই পৃথিবীকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ করা যায়।
প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর” | কবি বলছেন, যে ব্যক্তি তার ঘর ভেঙে দিয়েছে, তিনি সেই ব্যক্তির জন্য নতুন ঘর বানিয়ে দেবেন। এখানে ঘর ভাঙা মানে শুধু ঘর নয়, এটি জীবনের সুখ-শান্তি নষ্ট করার প্রতীক। কবি প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে ক্ষমা ও ভালোবাসা দেখানোর মাধ্যমে সেই ব্যক্তির উপকার করতে চান। |
“আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর” | কবি বলছেন, যে তাকে পর (অন্য) করে দিয়েছে, অর্থাৎ তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে বা তুচ্ছ করেছে, তিনি সেই ব্যক্তিকে আপন করে নেওয়ার জন্য কাঁদেন। তিনি তার জন্য দুঃখ বোধ করেন এবং তাকে কাছে টানতে চান। |
“যে মোরে করিল পথের বিরাগী—পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি” | যে তাকে পথ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, কবি সেই ব্যক্তির জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়ান। তিনি তার সুখ ও শান্তির জন্য চেষ্টা করেন এবং তাকে ফিরে পেতে চান। |
“দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর” | কবি সেই ব্যক্তির জন্য দীর্ঘ রাত জেগে কাটান। তার জন্য তিনি এতটাই চিন্তিত যে, তার ঘুম হারিয়ে গেছে। এটি কবির গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের প্রকাশ। |
“আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি” | যে ব্যক্তি তার জীবনের কূল (সীমা বা সুরক্ষা) ভেঙে দিয়েছে, কবি সেই ব্যক্তির জন্য নতুন কূল বানিয়ে দেন। এখানে কূল ভাঙা মানে নিরাপত্তাহীনতা বা বিপদ সৃষ্টি করা। কবি সেই ব্যক্তির বিপদ দূর করে তাকে সুরক্ষা দিতে চান। |
“যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি” | যে ব্যক্তি তার বুকে আঘাত করেছে, অর্থাৎ তাকে মানসিক বা শারীরিকভাবে কষ্ট দিয়েছে, কবি সেই ব্যক্তির জন্য কাঁদেন। তিনি তার কষ্টকে ভালোবাসায় পরিণত করতে চান। |
“যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ, আমি দেই তারে বুকভরা গান” | যে ব্যক্তি তাকে বিষে ভরা বাণ (কটু কথা বা আঘাত) দিয়েছে, কবি সেই ব্যক্তিকে বুকভরা গান (ভালোবাসা ও স্নেহ) দেন। তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে ভালোবাসা দিয়ে তার হৃদয় জয় করতে চান। |
“কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম-ভর” | যে ব্যক্তি তাকে কাঁটা (কষ্ট) দিয়েছে, কবি সেই ব্যক্তিকে ফুল (ভালোবাসা ও সুখ) দান করেন। তিনি সারাজীবন ধরে এই ভালোবাসা ও ক্ষমার পথে চলতে চান। |
“মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ান ফুল মালঞ্চ ধরি” | যে ব্যক্তি তার বুকে কবর বেঁধেছে, অর্থাৎ তাকে গভীর কষ্ট দিয়েছে, কবি সেই ব্যক্তির বুক রঙিন ফুলে ভরে দেন। তিনি তার হৃদয়কে ভালোবাসা ও স্নেহে ভরিয়ে দিতে চান। |
“যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী, আমি লয়ে করে তারি মুখখানি” | যে ব্যক্তি নিষ্ঠুর কথা বলেছে, কবি সেই ব্যক্তির মুখটি হাত দিয়ে ধরে নরম করে দেন। তিনি তার কঠোরতাকে ভালোবাসায় পরিণত করতে চান। |
“কত ঠাঁই হতে কত কী যে আনি সাজাই নিরন্তর” | কবি বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা রকম সুন্দর জিনিস এনে সেই ব্যক্তিকে সাজাতে চান। তিনি তার জীবনকে সুন্দর ও সুখময় করে তুলতে চান। |
“আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর” | কবি আবারও বলছেন, যে তাকে পর (অন্য) করে দিয়েছে, তিনি সেই ব্যক্তিকে আপন করে নেওয়ার জন্য কাঁদেন। তিনি তার জন্য গভীর মমত্ববোধ অনুভব করেন। |