শামসুর রাহমানের ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতাটি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংগ্রাম ও শহিদদের স্মৃতিকে ধারণ করে। কবিতাটিতে কৃষ্ণচূড়া ফুলকে শহিদের রক্তের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। নিচে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।
ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতার মূলভাব
শামসুর রাহমানের ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতাটি বাংলার মানুষের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের গল্প বলে। কবিতায় কৃষ্ণচূড়া ফুল ভাষা আন্দোলনের শহিদদের রক্তের প্রতীক। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের স্মৃতি এই ফুলের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। কবি দেখেন, শুধু কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙই নয়, আরেকটি অশুভ রঙও আছে, যা আমাদের চোখে ভালো লাগে না। এটি ঘাতকদের রঙ, যারা মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায়।
১৯৬৯ সালে বাংলার মানুষ আবার জেগে উঠেছে। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তারা রাস্তায় নেমেছে। সংগ্রামী মানুষেরা বাংলার মাটিকে ভালোবেসে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের রক্তে বাংলার মাটি আজও উর্বর, তাদের স্মৃতি আজও আমাদের প্রেরণা। এই কবিতা আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমেই আমরা আমাদের অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি।
ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে” | কবি বলছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে শহরের রাস্তায় আবার কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটেছে। এই ফুলগুলো শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এগুলো বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহিদদের রক্তের স্মৃতি জাগায়। |
“কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা শহিদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।” | এই ফুলগুলো এতটাই গভীরভাবে ফুটেছে যে, কখনো মিছিলে বা একা হাঁটার সময় মনে হয়, এগুলো শুধু ফুল নয়, এগুলো যেন শহিদদের রক্তের বুদ্বুদ। এই ফুলগুলো শহিদদের স্মৃতিতে ভরপুর। |
“একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রং” | একুশে ফেব্রুয়ারির কৃষ্ণচূড়া ফুলের লাল রঙ আমাদের চেতনার রঙ। এটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য আত্মত্যাগের প্রতীক। এই রঙ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা কতটা সাহসী ও সংগ্রামী। |
“এ-রঙের বিপরীত আছে অন্য রং, যে-রং লাগে না ভালো চোখে, যে-রং সন্ত্রাস আনে প্রাত্যহিকতায় আমাদের মনে সকাল-সন্ধ্যায়-“ | কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙের বিপরীতে আরেকটি অশুভ রঙ আছে, যা আমাদের চোখে ভালো লাগে না। এই রঙ সন্ত্রাস, ভয় ও অন্ধকারের প্রতীক। |
“এখন সে রঙে ছেয়ে গেছে পথ-ঘাট, সারা দেশ ঘাতকের অশুভ আস্তানা।” | এই অশুভ রঙে আমাদের পথ-ঘাট, সমাজ ও দেশ ছেয়ে গেছে। এটি ঘাতকদের আস্তানা, যারা মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার কেড়ে নিতে চায়। এই রঙ আমাদের মনে ভয় ও দুঃখ আনে। |
“আমি আর আমার মতোই বহু লোক রাত্রি-দিন ভুলুষ্ঠিত ঘাতকের আস্তানায়, কেউ মরা, আধমরা কেউ, কেউ বা ভীষণ জেদি, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া।” | কবি বলছেন, তিনি এবং তাঁর মতো অনেক মানুষ দিনরাত ঘাতকের আস্তানায় পিষ্ট হচ্ছেন। কেউ মারা গেছেন, কেউ আধমরা, আবার কেউ জেদি হয়ে বিপ্লবে ফেটে পড়ছেন। |
“চতুর্দিকে মানবিক বাগান, কমলবন হচ্ছে তছনছ।” | চারদিকে মানবিকতা, ন্যায় ও সুন্দরের জগৎ (যাকে তিনি ‘মানবিক বাগান’ ও ‘কমলবন’ বলেছেন) ধ্বংস হচ্ছে। |
“বুঝি তাই উনিশশো উনসত্তরেও আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ” | ১৯৬৯ সালেও বাংলার মানুষ আবার জেগে উঠেছে। এই আন্দোলনে সালামের মতো শহিদরা রাজপথে নেমেছেন, তারা পতাকা উঁচু করে ধরেছেন। |
“বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।” | বরকতের মতো শহিদরা ঘাতকের থাবার সামনে বুক পেতে দিয়েছেন। তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য। |
“সালামের চোখ আজ আলোচিত ঢাকা, সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।” | সালামের চোখ আজও ঢাকার রাজপথে আলোচিত। তার মুখ আজ তরুণ পূর্ব বাংলার প্রতীক। |
“দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই জনসাধারণ দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা” | কবি বলছেন, তিনি রাজপথে দেখেছেন যে, আমরা সবাই সাধারণ মানুষ। তিনি দেখেছেন, সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো বাংলা বর্ণমালা ঝরে পড়ছে। এটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতীক, যা শহিদদের রক্তে অমর হয়ে আছে। |
“আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে” | রকতের মতো শহিদদের গাঢ় উচ্চারণ আজও বাংলার মানুষের মনে প্রেরণা জোগায়। তাদের রক্তে ও মায়ের অশ্রুজলে বাংলার মাটিতে নতুন ফুল ফুটেছে। |
“হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায়। সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ, শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায়।” | এই ফুল (বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি) আমাদের হৃদয়ের সবুজ উপত্যকায় ফুটেছে। এটি আমাদের প্রাণ, যা আনন্দ ও দুঃখের সাথী। এটি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমেই আমরা আমাদের অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি। |