বঙ্গভূমির প্রতি কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

বঙ্গভূমির প্রতি কবিতাটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনা করেছেন, এবং এটি তাঁর দেশপ্রেম ও মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ। কবিতাটি প্রধানত কবির দেশের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং মাতৃভূমির প্রতি তাঁর নিবেদন। নিচে বঙ্গভূমির প্রতি কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।

বঙ্গভূমির প্রতি কবিতার মূলভাব

মাইকেল মধুসূদন দত্তের “বঙ্গভূমির প্রতি” কবিতার মূলভাব হলো কবির নিজস্ব দেশ, বাংলা বা বঙ্গভূমির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। কবি এখানে তার মাতৃভূমিকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং প্রবাসে থাকা অবস্থায় তিনি মা তথা দেশমাতৃকার কাছে আবেদন করেছেন, যেন মা তার সব দোষ ক্ষমা করে দেন। কবি নিজেকে একজন সন্তানের মতো ভাবছেন, যে ভুল করেছে, কিন্তু মা (দেশ) তাকে ক্ষমা করে দেবে।

এছাড়াও কবি তার জীবনের মহত্ব বা গুণের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, তার মধ্যে এমন কোনো গুণ নেই, যার কারণে তিনি স্মরণীয় হতে পারেন। তবে, তিনি চাইছেন যে, তার ছোট্ট অবদান, ভালোবাসা, ও শ্রদ্ধা যেন দেশের স্মৃতিতে সদা চিরকাল অব্যক্তভাবে থেকে যায়, ঠিক যেমন একটি পদ্মফুল দেশের জলাশয়ে ফুটে থাকে। এভাবে কবি দেশপ্রেমের মাধ্যমে তার দেশকে মা হিসেবে মেনে নিয়ে দেশমাতৃকার কাছে নিজের অস্তিত্ব চিরকাল স্মরণীয় করে রাখার প্রার্থনা করেছেন।

বঙ্গভূমির প্রতি কবিতার ব্যাখ্যা

লাইনব্যাখ্যা
“রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।”কবি তাঁর মাতৃভূমির কাছে প্রার্থনা করছেন, যেন দেশ তাঁকে মনে রাখে এবং তাঁর সমস্ত কৃতকর্মকে নিজের দাস হিসেবে গ্রহণ করে।
“সাধিতে মনের সাধ, ঘটে যদি পরমাদ, মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।”এখানে কবি বলেছেন যে, তাঁর মানসিক ইচ্ছা বা সাধ পূর্ণ হবে, কিন্তু যদি কোনো ভুল হয়, তবে তিনি চান দেশ তাঁর মন থেকে মধুর সুরের মতো একেবারে হারিয়ে না যাক, যেন সে ভুল ভুলে গিয়ে তাঁর ভালোবাসা না কমে।
“প্রবাসে, দৈবের বশে, জীবন তারা যদি খসে, এ দেহ-আকাশ হতে, নাহি খেদ তাহে।”কবি প্রবাসে থাকাকালীন যদি তাঁর জীবন শেষ হয়ে যায়, তবে তিনি তা নিয়ে দুঃখ করবেন না, কারণ তিনি জানেন যে, দেহের মৃত্যু একটি অবধারিত বিষয়। এটা পৃথিবী থেকে চলে যাবে, কিন্তু তাঁর আত্মা চিরকাল থাকবে।
“জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে, চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?”কবি জীবনের অমোঘ সত্য তুলে ধরছেন যে, জন্ম নেওয়ার পর একদিন মরতেই হবে। কোনো মানুষই অমর হতে পারে না। জীবন নদীর মতো প্রবাহিত হয়, যা কখনো থামে না এবং একসময় মৃত্যুর দিকে চলে যায়। এই সত্যের সঙ্গে কবি মানবজীবনের অনিশ্চয়তা সম্পর্কে ভাবছেন।
“কিন্তু যদি রাখ মনে, নাহি, মা, ডরি শমনে; মক্ষিকাও গলে না গো পড়িলে অমৃত-হ্রদে।”এখানে কবি বলছেন, যদি তাঁর মাতৃভূমি তাঁকে মনে রাখে এবং তাঁর জন্য কোনো ভ্রান্তি বা ভুল না দেখে, তবে তাঁর ভয় থাকবে না। তিনি জানেন, যদি তাঁর হৃদয়ে দেশমাতৃকার ভালোবাসা থাকে, তবে তার জীবন অমৃতের মতো হবে, কারণ মক্ষিকা (মাছি) অমৃতের হ্রদে পড়লে সে গলে যায়, তেমনই দেশমাতৃকার স্মৃতিতে ভরা জীবন একে অপরকে অমর করে দেয়।
“সেই ধন্য নরকুলে, লোকে যারে নাহি ভুলে, মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্বজন;”কবি এখানে এমন মানুষের কথা বলেছেন, যে মানুষ তাঁর দেশ বা মাটির প্রতি শ্রদ্ধা রাখে এবং দেশের ইতিহাস, সংগ্রাম ও মানুষকে ভুলতে দেয় না। সেই ব্যক্তি চিরকাল মানুষের মনে এবং মনের মন্দিরে বসবাস করে।
“কিন্তু কোন গুণ আছে, যাচিব যে তব কাছে, হেন অমরতা আমি, কহ, গো, শ্যামা জন্মদে!”এখানে কবি নিজের গুণের দিকে নির্দেশ করে বলছেন, ‘আমার মধ্যে এমন কিছু গুণ নেই যা আমাকে অমর করে রাখতে পারে, তবে যদি তুমি দয়া করে আমাকে অমর হওয়ার সুযোগ দাও, তবে আমি তোমার কাছে সেই আশীর্বাদ চাই।’
“তবে যদি দয়া কর, ভুল দোষ, গুণ ধর অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে!”কবি দেশমাতৃকার কাছে আবার প্রার্থনা করছেন, যেন তিনি তাঁর ভুল এবং দোষগুলো ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর গুণগুলো গ্রহণ করে, যাতে তিনি দেশ ও সমাজের কাছে অমর হয়ে থাকেন।
“ফুটি যেন স্মৃতি-জলে, মানসে, মা, যথা ফলে মধুময় তামরস কী বসন্ত, কী শরদে!”কবি আবার মাতৃভূমির কাছে তাঁর প্রার্থনা জানান, যাতে তাঁর স্মৃতিগুলি মধুর হয় এবং সেগুলি মানুষের মনেও ভালোভাবে ফুটে ওঠে। তিনি চান, তার এই স্মৃতি যেন বসন্ত এবং শরতের মতো রঙিন, মধুর এবং চিরকালীন হয়ে থাকে।

Related Posts

Leave a Comment