কালিদাস রায়ের ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ কবিতাটি মুঘল সম্রাট বাবুরের মহানুভবতা ও ন্যায়পরায়ণতার চিত্র তুলে ধরে। নিচে বাবুরের মহত্ত্ব কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।
বাবুরের মহত্ত্ব কবিতার মূলভাব
মুঘল সম্রাট বাবুর ভারতবর্ষ জয় করার পর প্রজাদের হৃদয় জয় করার চেষ্টা করেন। তিনি শুধু রাজ্য জয় করেই থেমে থাকেননি, বরং প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু রাজপুতরা বাবুরকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের একজন তরুণ যোদ্ধা, রণবীর চৌহান, বাবুরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। সে দিল্লির রাজপথে ঘুরতে থাকে, বাবুরের সন্ধানে। একদিন রাজপথে একটি মত্ত হাতি ছুটে আসে। সবাই ভয়ে পথ ছেড়ে পালায়, কিন্তু একটি মেথর শিশু পথে পড়ে থাকে। হাতির পায়ের নিচে পড়ে শিশুটির প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হয়। এমন সময় বাবুর ছদ্মবেশে সেখানে উপস্থিত হন। তিনি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে শিশুটিকে বাঁচান।
এই ঘটনায় রণবীর চৌহান বাবুরের মহানুভবতা দেখে মুগ্ধ হয়। সে বুঝতে পারে যে, বাবুর শুধু একজন শক্তিশালী সম্রাটই নন বরং একজন মহানুভব ও মানবিক মানুষ। রণবীর চৌহান বাবুরের পায়ে পড়ে নিজের ভুল স্বীকার করে এবং ক্ষমা চায়। সে বাবুরকে হত্যা করতে এসেছিল, কিন্তু এখন তার মনে বাবুরের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মেছে। বাবুর রণবীর চৌহানকে ক্ষমা করেন এবং তাকে নিজের দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত করেন।
বাবুরের মহত্ত্ব কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“বাদশা লোদি পানিপথে হত। দখল করিয়া দিল্লির শাহিগদি,” | ইব্রাহিম লোদি পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত হন। বাবুর দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। এই লাইনে বাবুরের ভারত বিজয়ের কথা বলা হয়েছে। |
“দেখিল বাবুর এ-জয় তাঁহার ফাঁকি, ভারত যাদের তাদেরি জিনিতে এখনো রয়েছে বাকি।” | বাবুর বুঝতে পারলেন যে শুধু যুদ্ধে জয়লাভ করাই যথেষ্ট নয়। ভারতের মানুষের হৃদয় জয় করা এখনও বাকি আছে। |
“গর্জিয়া উঠিল সংগ্রাম সিং, ‘জিনেছ মুসলমান, জয়ী বলিব না এ দেহে রহিতে প্রাণ।'” | রাজপুত বীর সংগ্রাম সিং বাবুরের বিরুদ্ধে রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি বললেন, “তুমি শুধু মুসলমানদের জয় করেছ, কিন্তু যতদিন আমার প্রাণ আছে, ততদিন আমি তোমাকে জয়ী মানব না।” |
“লয়ে লুণ্ঠিত ধন দেশে ফিরে যাও, নতুবা মুঘল, রাজপুতে দাও রণ।” | সংগ্রাম সিং বাবুরকে বললেন, “লুট করা ধন নিয়ে দেশে ফিরে যাও, নাহলে রাজপুতদের সাথে যুদ্ধে নামো।” |
“খানুয়ার প্রান্তরে সেই সিংহেরো পতন হইল বীর বাবুরের করে।” | খানুয়ার যুদ্ধে সংগ্রাম সিং পরাজিত হন। বাবুরের বীরত্বে রাজপুত বীরের পতন ঘটে। |
“এ বিজয় তার স্বপ্ন-অতীত, যেন বা দৈব বলে সারা উত্তর ভারত আসিল বিজয়ীর করতলে।” | বাবুরের এই বিজয় তার স্বপ্নের চেয়েও বড় ছিল। যেন ভাগ্যের জোরে সমগ্র উত্তর ভারত তার অধীনে চলে আসে। |
“কবরে শায়িত কৃতঘ্ন দৌলত, বাবুরের আর নাই কোনো প্রতিরোধ।” | দৌলত খান নামে এক বিশ্বাসঘাতক মারা গেছেন। এখন বাবুরের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ নেই। |
“দস্যুর মতো তুষ্ট না হয়ে লুণ্ঠিত সম্পদে, জাঁকিয়া বসেছে মুঘল সিংহ দিল্লির মসনদে।” | বাবুর লুটের মাল নিয়ে সন্তুষ্ট হননি। তিনি দিল্লির সিংহাসনে গর্বের সাথে বসেছেন। |
“মাটির দখলই খাঁটি জয় নয় বুঝেছে বিজয়ী বীর, বিজিতের হৃদি দখল করিবে এখন করেছে স্থির।” | বাবুর বুঝলেন যে শুধু ভূখণ্ড জয় করাই আসল বিজয় নয়। বিজিত মানুষের হৃদয় জয় করাই এখন তার লক্ষ্য। |
“প্রজারঞ্জনে বাবুর দিয়াছে মন, হিন্দুর-হৃদি জিনিবার লাগি করিতেছে সুশাসন।” | বাবুর প্রজাদের খুশি করতে চান। হিন্দুদের হৃদয় জয় করার জন্য তিনি সুশাসন চালু করেন। |
“ধরিয়া ছদ্মবেশ ঘুরি পথে পথে খুঁজিয়ে প্রজার কোথায় দুঃখ ক্লেশ।” | বাবুর ছদ্মবেশে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট খুঁজে বের করেন। |
“চিতোরের এক তরুণ যোদ্ধা রণবীর চৌহান করিতেছে আজি বাবুরের সন্ধান।” | চিতোরের এক যুবক যোদ্ধা, রণবীর চৌহান, বাবুরকে হত্যা করার জন্য তার সন্ধান করছে। |
“কুর্তার তলে কৃপাণ লুকায়ে ঘুরিছে সে পথে পথে দেখা যদি তার পায় আজি কোনো মতে লইবে তাহার প্রাণ।” | রণবীর চৌহান তার কাপড়ের নিচে তরবারি লুকিয়ে রাস্তায় ঘুরছে। যদি কোনোভাবে বাবুরকে পায়, তবে তার প্রাণ নেবে। |
“দাঁড়ায়ে যুবক দিল্লির পথ-পাশে লক্ষ করিছে জনতার মাঝে কেবা যায় কেবা আসে।” | যুবকটি দিল্লির রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে লোকজনের চলাফেরা লক্ষ করছে। |
“হেন কালে এক মত্ত হস্তী ছুটিল পথের পরে পথ ছাড়ি সবে পলাইয়া গেল ভরে।” | এমন সময় একটি পাগল হাতি রাস্তায় ছুটে আসে। সবাই ভয়ে পথ ছেড়ে পালায়। |
“সকলেই গেল সরি কেবল একটি শিশু রাজপথে রহিল ধুলায় পড়ি।” | সবাই পালাল, কিন্তু একটি শিশু রাস্তায় ধুলায় পড়ে থাকে। |
“হাতির পায়ের চাপে ‘গেল গেল’ বলি হায় হায় করি পথিকেরা ভয়ে কাঁপে।” | হাতির পায়ের নিচে শিশুটির প্রাণ যাবে ভেবে পথিকেরা ভয়ে কাঁপতে থাকে। |
“‘কুড়াইয়া আন ওরে’ সকলেই বলে অথচ কেহ না আগায় সাহস করে।” | সবাই শিশুটিকে বাঁচানোর কথা বলে, কিন্তু কেউ সাহস করে এগিয়ে আসে না। |
“সহসা একটি বিদেশি পুরুষ ভিড় ঠেলে যায় ছুটে ‘কর কী কর কী’ বলিয়া জনতা চিৎকার করি উঠে।” | হঠাৎ একজন বিদেশি লোক ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়। সবাই চিৎকার করে তাকে থামানোর চেষ্টা করে। |
“করী-শুণ্ডের ঘর্ষণ দেহে সহি পথের শিশুরে কুড়ায়ে বক্ষে বহি ফিরিয়া আসিল বীর।” | সেই লোকটি হাতির শুঁড়ের আঘাত সহ্য করে শিশুটিকে বাঁচায় এবং তার বুকে জড়িয়ে ফিরে আসে। |
“চারি পাশে তার জমিল লোকের ভিড়। বলিয়া উঠিল এক জন, ‘আরে এ যে মেথরের ছেলে।” | লোকেরা ভিড় জমায়। একজন বলে, “এ তো মেথরের ছেলে, এর জন্য এত সাহস দেখালে?” |
“ইহার জন্য বে-আকুফ তুমি তাজা প্রাণ দিতে গেলে? খুদার দয়ায় পেয়েছ নিজের জান, ফেলে দিয়ে ওরে এখন করগে স্নান।” | তারা বলে, “এত বোকামি করলে কেন? নিজের প্রাণ বাঁচালে, এখন শিশুটিকে ফেলে স্নান (গোসল) করে নাও।” |
“শিশুর জননী ছেলে ফিরে পেয়ে বুকে বক্ষে চাপিয়া চুমু দেয় তার মুখে।” | শিশুটির মা তাকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে এবং তার মুখে চুমু খায়। |
“বিদেশি পুরুষে রাজপুত বীর চিনিল নিকটে এসে, এ যে বাদশাহ স্বয়ং বাবুর পর্যটকের বেশে।” | রাজপুত যুবক রণবীর চৌহান বুঝতে পারে যে এই বিদেশি লোকটি ছদ্মবেশে বাবুর নিজেই। |
“ভাবিতে লাগিল, ‘হরিতে ইহারই প্রাণ পথে পথে আমি করিতেছি সন্ধান?” | রণবীর চৌহান ভাবে, “আমি এই মহান মানুষটির প্রাণ নেওয়ার জন্য এত চেষ্টা করছি?” |
“বাবুরের পায়ে পড়ি সে তখন লুটে কহিল সঁপিয়া গুপ্ত কৃপাণ বাবুরের করপুটে।” | রণবীর চৌহান বাবুরের পায়ে পড়ে যায় এবং তার গোপন তরবারি বাবুরের হাতে সমর্পণ করে। |
“জাঁহাপনা, এই ছুরিখানা দিয়ে আপনার প্রাণবধ করিতে আসিয়া একি দেখিলাম। ভারতের রাজপদ সাজে আপনারে, অন্য কারেও নয়।” | রণবীর চৌহান বলে, “হুজুর, আমি আপনার প্রাণ নেওয়ার জন্য এসেছিলাম, কিন্তু এখন বুঝেছি যে ভারতের সিংহাসন শুধু আপনারই যোগ্য।” |
“বীরভোগ্যা এ বসুধা এ কথা সবাই কয়, ভারতভূমির যোগ্য পালক যেবা, তাহারে ছাড়িয়া, এ ভূমি অন্য কাহারে করিবে সেবা?” | রণবীর চৌহান বলে, “বীররাই পৃথিবী ভোগ করে। ভারতের যোগ্য শাসক আপনি, অন্য কেউ নয়।” |
“কেটেছে আমার প্রতিহিংসার অন্ধ মোহের ঘোর, সঁপিনু জীবন, করুন এখন দণ্ডবিধান মোর।” | রণবীর চৌহান বলে, “আমার প্রতিহিংসার অন্ধকার কেটে গেছে। এখন আমার জীবন আপনার হাতে, আপনি যা চান তাই করুন।” |
“রাজপথ হতে উঠায়ে যুবকটিরে কহিল বাবুর ধীরে, ‘বড়ই কঠিন জীবন দেওয়া যে জীবন নেওয়ার চেয়ে।” | বাবুর রণবীর চৌহানকে তুলে ধীরে বলেন, “জীবন দেওয়া জীবন নেওয়ার চেয়ে কঠিন।” |
“জান না কি ভাই? ধন্য হলাম আজিকে তোমারে পেয়ে আজি হতে মোর শরীর রক্ষী হও।” | বাবুর বলেন, “তুমি জানো না, আজ আমি তোমাকে পেয়ে ধন্য হয়েছি। এখন থেকে তুমি আমার দেহরক্ষী হবে।” |
“প্রাণরক্ষকই হইলে আমার, প্রাণের ঘাতক নও।” | বাবুর বলেন, “আমি তোমাকে প্রাণের রক্ষক করলাম, প্রাণ নেওয়ার না।।” |