কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতায় নজরুল বিদ্রোহ, স্বাধীনতা, শক্তি এবং অহংকারের প্রতীক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। নিচে বিদ্রোহী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন দেওয়া হল।
বিদ্রোহী কবিতার মূলভাব
বিদ্রোহী কবিতাটিতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী চেতনা, সাম্যবাদী দর্শন এবং মানবতার প্রতি গভীর ভালোবাসাকে ফুটিয়ে তোলে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে ধ্বংস ও সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি শৃঙ্খল ভাঙার প্রতীক, তিনি আইন মানেন না, তিনি বিদ্রোহের মূর্ত প্রতীক। তিনি নিজেকে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিশালী উপাদানের সাথে তুলনা করেছেন, যেমন সাইক্লোন, টর্পেডো, ভাসমান মাইন, ঝড়, দাবানল ইত্যাদি। এগুলো সবই তার বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ।
নজরুল এই কবিতায় সামাজিক অবিচার, অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি শান্তি চান, কিন্তু সেই শান্তি তখনই আসবে যখন অত্যাচারীর খড়গ আর রণভূমে শোনা যাবে না, যখন উৎপীড়িতের ক্রন্দন আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হবে না। “বিদ্রোহী” কবিতাটি নজরুলের সাহস, স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং মানবতার প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসাকে প্রকাশ করে। এটি বাংলা সাহিত্যে একটি যুগান্তকারী রচনা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং আজও এটি পাঠকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
বিদ্রোহী কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“বল বীর- বল উন্নত মম শির।” | কবি বলছেন, তিনি একজন বীর, তার মাথা সবসময় উঁচু। তিনি কারো কাছে মাথা নত করেন না। |
“শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!” | তার মাথা দেখে হিমালয় পর্বতও মাথা নত করে। অর্থাৎ, তার আত্মবিশ্বাস এবং শক্তি এতটাই বেশি যে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় পর্বতও তার সামনে নত হয়। |
“আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস।” | তিনি কখনোই দমিয়ে রাখা যায় না। তিনি শক্তিশালী, অবাধ্য এবং ধ্বংসের প্রতীক। তিনি প্রলয়ের নটরাজ (শিব), সাইক্লোন এবং ধ্বংসের মূর্তি। |
“আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার।” | তিনি ভয়ের প্রতীক, পৃথিবীর অভিশাপ। তিনি অদম্য এবং সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দেন। |
“আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।” | কবি বলছেন, তিনি নিয়ম-কানুন মানেন না। তিনি সব বন্ধন এবং শৃঙ্খল ভেঙে ফেলেন। |
“আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন।” | তিনি কোনো আইন মানেন না। তিনি ভরা নৌকাকে ডুবিয়ে দেন, তিনি টর্পেডো এবং ভাসমান মাইনের মতো ধ্বংসাত্মক শক্তি। |
“আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর।” | কবি নিজেকে শিব (ধূর্জটি) এবং অকালবৈশাখীর ঝড়ের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি এলোমেলো চুলের মতো উন্মুক্ত এবং শক্তিশালী। |
“আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!” | তিনি বিদ্রোহী, তিনি বিশ্ব সৃষ্টিকর্তার বিদ্রোহী সন্তান। তিনি সবকিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। |
“আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিশাবসান।” | তিনি সৃষ্টি এবং ধ্বংস উভয়ই। তিনি লোকালয় (মানব বসতি) এবং শ্মশান (মৃত্যুস্থান) উভয়ই। তিনি দিনের শেষ এবং রাতের অবসানের মতো। |
“আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য, মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ-তূর্য।” | কবি বলছেন, তার এক হাতে চাঁদ এবং সূর্য, আর অন্য হাতে বাঁশি এবং যুদ্ধের তূর্য (বাদ্যযন্ত্র)। তিনি সৃষ্টি এবং ধ্বংস উভয়ই করেন। |
“আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।” | তিনি বেদুঈন (যাযাবর) এবং চেঙ্গিস খানের মতো শক্তিশালী। তিনি শুধু নিজেকে সম্মান করেন, অন্য কাউকে নতজানু হন না। |
“আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওস্কার, আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার।” | তিনি বজ্রপাতের মতো শক্তিশালী, তিনি শিবের শিঙার ধ্বনি এবং ইস্রাফিলের শিঙার হুঙ্কারের মতো ভয়ানক। |
“আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড!” | তিনি শিবের ডমরু (বাদ্যযন্ত্র) এবং ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, বিষ্ণুর চক্র এবং শঙ্খের মতো শক্তিশালী। তিনি প্রণব-নাদ (ওঁকার ধ্বনি) এর মতো প্রচণ্ড। |
“আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।” | তিনি দুর্বাসা এবং বিশ্বামিত্রের মতো ক্রুদ্ধ এবং ক্ষিপ্ত। তিনি দাবানলের মতো পুরো বিশ্বকে পুড়িয়ে দেবেন। |
“আমি উন্মন মন উদাসীর, আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।” | কবি বলছেন, তার মন উদাস এবং উন্মুক্ত। তিনি বিধবার কান্না এবং হাহুতাশের মতো বেদনাদায়ক। |
“আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের।” | তিনি বঞ্চিত, গৃহহারা পথিক এবং অবমানিত মানুষের বেদনার প্রতীক। তিনি তাদের কষ্ট এবং যন্ত্রণাকে বুকে ধারণ করেন। |
“আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া, আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।” | তিনি উত্তর বায়ু এবং মলয় বাতাসের মতো উদাস। তিনি পথিক-কবির গভীর গান, বেণু এবং বীণায় গান গাইতে পারেন। |
“আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি, আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!” | কবি বলছেন, তিনি গ্রীষ্মের তৃষ্ণা, রৌদ্রের তীব্রতা, মরুভূমির ঝরনা এবং সবুজ ছায়ার মতো বৈচিত্র্যময়। |
“আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরি, মহা-সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম, ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝুম।” | তিনি অর্ফিয়াসের বাঁশির মতো মোহনীয়। তিনি বিশাল সাগরের মতো উত্তাল, কিন্তু তার সুরে পুরো বিশ্ব শান্ত হয়ে যায়। |
“আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ হাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।” | কবি বলছেন, যখন তিনি রেগে যান, তখন মহাকাশ কাঁপে। তার রাগে সাতটি নরকও ভয়ে কাঁপতে থাকে। |
“আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া।” | তিনি বিদ্রোহের বাহক, তার বিদ্রোহ সমগ্র বিশ্বকে আচ্ছন্ন করে। |
“আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার।” | কবি বলছেন, তিনি পরশুরামের কুঠারের মতো কঠোর। তিনি ক্ষত্রিয়দের (যোদ্ধাদের) নিধন করে বিশ্বে শান্তি আনবেন। |
“আমি হল বলরাম-স্কন্ধে, উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।” | তিনি বলরামের লাঙ্গলের মতো শক্তিশালী। তিনি পুরোনো বিশ্বকে উল্টে ফেলে নতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠবেন। |
“মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।” | কবি বলছেন, তিনি বিদ্রোহে ক্লান্ত, কিন্তু তিনি শান্ত হবেন তখনই যখন উৎপীড়িত মানুষের কান্না আর শোনা যাবে না, যখন অত্যাচারীর তরবারি যুদ্ধক্ষেত্রে শোনা যাবে না। |
“বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত।” | তিনি বিদ্রোহে ক্লান্ত, কিন্তু তিনি শান্ত হবেন যখন অন্যায়ের অবসান হবে। |
“আমি চির-বিদ্রোহী বীর- আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!” | কবি বলছেন, তিনি চিরকালের বিদ্রোহী বীর। তিনি বিশ্বকে ছাড়িয়ে একা দাঁড়িয়েছেন, তার মাথা সবসময় উঁচু। |