মমতাদি গল্পের মূলভাব ও বিষয়বস্তু – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মমতাদি’ গল্পটি একজন সাধারণ গৃহকর্মীর জীবন সংগ্রাম, তার আত্মমর্যাদাবোধ, এবং সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের কষ্ট ও সংগ্রামকে খুবই সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলে। মমতাদি গল্পের মূলভাব ও বিষয়বস্তু দেওয়া হল।

মমতাদি গল্পের মূলভাব

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মমতাদি’ গল্পটি একজন সাধারণ গৃহকর্মীর জীবন সংগ্রামকে খুবই মর্মস্পর্শীভাবে তুলে ধরে। গল্পের নায়িকা মমতাদি, যার স্বামী বেকার এবং একটি ছেলে আছে, সংসার চালানোর জন্য সে পর্দা ঠেলে কাজ করতে বের হয়। কথকের বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়ে সে খুবই নিষ্ঠার সাথে তার দায়িত্ব পালন করে। মমতাদি কথা কম বলে, কিন্তু তার কাজের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা সবাইকে মুগ্ধ করে। কথক তাকে খুব পছন্দ করে এবং তার সাথে ভাব করতে চায়। একদিন কথক দেখে মমতাদির গালে আঙুলের দাগ, যা থেকে বোঝা যায় তার স্বামী তাকে মেরেছে। মমতাদির জীবন যে কতটা কষ্টের, তা কথক ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে। কিছুদিন পর মমতাদি জানায়, তার স্বামীর চাকরি হয়েছে, কিন্তু সে কাজ ছেড়ে দিতে রাজি নয়, কারণ তার স্বামীর আয় এখনও সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। মমতাদির আত্মমর্যাদাবোধ ও দায়িত্ববোধ কথককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

মমতাদি গল্পের বিষয়বস্তু

গল্পের সূচনা:

গল্পটি শুরু হয় একটি শীতের সকালে। গল্পের কথক, একটি ছেলে, তার স্কুলের পড়া করছে। তার মা কাছে বসে ফুলকপি কুটছেন। এমন সময় মমতাদি নামের একজন যুবতী মহিলা এসে তাদের বাড়িতে রান্নার কাজের জন্য আবেদন করে। মমতাদির পরনে একটি ময়লা শাড়ি, মুখে শ্রান্তির ছাপ, কিন্তু তার চোখে একটি দৃঢ়তা আছে। সে বলে, সে রান্না করতে জানে এবং ছোটখাটো কাজও করতে পারে। তার স্বামী বেকার, এবং তাদের একটি ছেলে আছে। সংসার চালানোর জন্য সে কাজ খুঁজছে।

মমতাদির সরলতা ও আত্মবিশ্বাসে মুগ্ধ হয়ে কথকের মা তাকে পনেরো টাকা মাইনে দিয়ে কাজে রাখেন। মমতাদি খুবই নিষ্ঠার সাথে কাজ করে। সে কথা কম বলে, কিন্তু তার কাজের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা সবাইকে মুগ্ধ করে। কথক (ছেলেটি) মমতাদিকে খুব পছন্দ করে এবং তার সাথে ভাব করতে চায়। কিন্তু মমতাদি প্রথমে তাকে দূরে রাখে, পরে ধীরে ধীরে তার সাথে মিশতে শুরু করে।


মমতাদির জীবন সংগ্রাম:

মমতাদির জীবন খুবই কষ্টের। তার স্বামী চার মাস ধরে বেকার, সংসার চালানোর জন্য সে বাধ্য হয়ে পর্দা ঠেলে বাইরে কাজ করতে এসেছে। তার ছেলেটি ছোট, এবং তার স্বামীর সাথে সম্পর্কও খুব ভালো নয়। একদিন কথক দেখে মমতাদির গালে আঙুলের দাগ। সে জিজ্ঞাসা করলে মমতাদি বলে, সে নিজেই গালে চড় মেরেছে। কিন্তু কথক বুঝতে পারে, তার স্বামী তাকে মেরেছে। মমতাদির জীবন যে কতটা কষ্টের, তা কথক ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে।

মমতাদি তার কাজে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। সে কোনো কাজ ফেলে রাখে না, কোনো প্রশ্ন করে না, এবং সব কাজ খুব সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে। তার কাজের প্রতি এই নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ সবাইকে মুগ্ধ করে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন খুবই বেদনাদায়ক। তার স্বামীর সাথে সম্পর্ক ভালো নয়, এবং সে তার ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটায়।


মমতাদির আত্মমর্যাদাবোধ:

কিছুদিন পর মমতাদি জানায়, তার স্বামীর চাকরি হয়েছে। কথকের মা তাকে কাজ ছেড়ে দিতে বলেন, কিন্তু মমতাদি বলে, তার স্বামীর আয় এখনও সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। সে কাজ চালিয়ে যেতে চায়। মমতাদির এই আত্মমর্যাদাবোধ ও দায়িত্ববোধ কথককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মমতাদি শুধু একটি গৃহকর্মী নয়, সে একজন সংগ্রামী নারী, যার জীবন কঠিন, কিন্তু তার মন খুবই মহান।


গল্পের শেষ অংশ:

গল্পের শেষে কথক মমতাদির বাড়িতে যায়। সেখানে সে দেখে মমতাদির জীবন কতটা দরিদ্র ও সংগ্রামময়। তার বাড়িটি অন্ধকার, নোংরা এবং খুবই ছোট। মমতাদি তার ছেলের যত্ন নেয় এবং কথককে একটু ভালোবাসা ও স্নেহ দেয়। কথক বুঝতে পারে, মমতাদি শুধু একটি গৃহকর্মী নয়, সে একজন সংগ্রামী নারী, যার জীবন কঠিন, কিন্তু তার মন খুবই মহান।


গল্পের মূল বার্তা:

‘মমতাদি’ গল্পটি দারিদ্র্য, সংগ্রাম, এবং নারীর আত্মমর্যাদার গল্প। মমতাদি চরিত্রটি একজন সাধারণ নারী, কিন্তু তার মধ্যে অসাধারণ দৃঢ়তা ও মানবিকতা আছে। গল্পটি আমাদের শেখায় যে, সামাজিক অবস্থান বা আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, মানুষের আত্মমর্যাদা ও দায়িত্ববোধই তাকে মহান করে তোলে। মমতাদির মতো মানুষের জীবন আমাদের সমাজের প্রতিফলন, যাদের কষ্ট ও সংগ্রামকে আমরা অনেক সময় উপেক্ষা করি।

Related Posts

Leave a Comment