মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “মাসি-পিসি” গল্পে মাসি এবং পিসি দুজন বিধবা নারী, যারা তাদের ভাইঝি আহ্লাদির দেখভাল করে এবং তাকে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে চায়। গল্পে তাদের সংগ্রাম, সাহস চিত্রিত হয়েছে। নিচে মাসি পিসি গল্পের মূলভাব ও বিষয়বস্তু দেওয়া হল।
মাসি পিসি গল্পের মূলভাব বা মূল কথা
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “মাসি-পিসি” গল্পটি একটি গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত, যেখানে দুজন বিধবা নারী—মাসি এবং পিসি—তাদের ভাইঝি আহ্লাদির জীবন রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে।
গল্পটি শুরু হয় গ্রামের একটি খালের পাশে, যেখানে মাসি এবং পিসি দুজন বিধবা নারী থাকেন। তারা দুজনই খুব গরিব এবং সংসারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের ভাইঝি আহ্লাদি, যার বাবা-মা মারা গেছেন, তার দেখভাল করেন তারা। আহ্লাদি একটি যুবতী মেয়ে, যার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু সে তার শ্বশুরবাড়ি যেতে চায় না। কারণ সেখানে তার স্বামী জগু এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে নিয়ে অত্যাচার করে। মাসি এবং পিসি আহ্লাদিকে খুব ভালোবাসেন এবং তাকে রক্ষা করতে চান। একদিন কৈলাশ নামের একজন লোক মাসি-পিসিকে বলে যে আহ্লাদির স্বামী জগু তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মামলা করতে চায়। জগু বলেছে যে আহ্লাদিকে জোর করে আটকে রাখা হচ্ছে, এবং আইন অনুযায়ী সে তার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে পারে। মাসি এবং পিসি এই কথা শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারা আহ্লাদিকে জিজ্ঞাসা করে, সে কি শ্বশুরবাড়ি যেতে চায়? আহ্লাদি কাঁদতে কাঁদতে বলে যে সে শ্বশুরবাড়ি যেতে চায় না, কারণ সেখানে তাকে মারধর করা হয় এবং অত্যাচার করা হয়। মাসি এবং পিসি তখন সিদ্ধান্ত নেন যে তারা আহ্লাদিকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন না। তারা বুঝতে পারেন যে জগু এবং তার দলবল আহ্লাদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের উপর চাপ তৈরি করবে। তারা গ্রামের লোকজনের সাহায্য চান এবং আহ্লাদিকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হন।
মাসি পিসি গল্পের বিষয়বস্তু
গল্পটি একটি গ্রামের পটভূমিতে শুরু হয়, যেখানে খালে ভাটার সময় জল নেমে গেছে এবং কাদা ও আবর্জনা জমে আছে। সেখানে কিছু মানুষ খড় তুলছে এবং সালতি (ছোট নৌকা) বেয়ে কাজ করছে। এই দৃশ্যে আমরা মাসি ও পিসি নামে দুজন বিধবা মহিলাকে দেখি, যারা সালতি বেয়ে খড় তুলছে। তারা আহ্লাদি নামে একটি অল্পবয়সী মেয়ের দেখভাল করে। আহ্লাদির বাবা-মা মারা গেছেন, এবং মাসি-পিসিই তার একমাত্র আশ্রয়। তারা খুব দরিদ্র, কষ্টে জীবনযাপন করে, কিন্তু আহ্লাদির জন্য তারা সবকিছু করতে প্রস্তুত।
মাসি ও পিসি দুজনই আহ্লাদির দেখভাল করে, কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্কটি খুব জটিল। পিসি আহ্লাদির বাবার বাড়ির মেয়ে, তাই সে নিজেকে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। মাসি, যিনি আহ্লাদির মায়ের বোন, তিনি এই বাড়িতে এসে জুড়ে বসেছেন। পিসির মনে মাসির প্রতি একটু অবজ্ঞা ও অবহেলার ভাব আছে। কিন্তু যখন আহ্লাদির কথা আসে, তখন তাদের মধ্যে সব বিরোধ মিটে যায়। তারা দুজনেই আহ্লাদির জন্য এক হয়ে যায়। আহ্লাদিকে খাওয়ানো, পরানো এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
আহ্লাদির শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে যেতে চায় না। সে জানে যে সেখানে তার ভালো থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই, বরং সে নির্যাতনের শিকার হয়। মাসি ও পিসি আহ্লাদিকে জোর করে পাঠাতে রাজি নয়। তারা তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত এবং তাকে রক্ষা করতে চায়। তারা আহ্লাদির জন্য তাদের নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে দেয়।তারা বুঝতে পারে যে আহ্লাদির বাবা-মা বেঁচে থাকলে হয়তো তাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে হতো, কিন্তু এখন তারা দুজনই আহ্লাদির একমাত্র আশ্রয়। তারা আহ্লাদিকে কোনোভাবেই জগুর (আহ্লাদির স্বামী) হাতে তুলে দিতে রাজি নয়। আহ্লাদির জমি-জমা এবং সম্পত্তির জন্য জগুর লোভও তাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কৈলেশ নামের একজন লোক এসে মাসি ও পিসিকে বলে যে আহ্লাদির স্বামী জগু মামলা করতে চায়, কারণ তারা আহ্লাদিকে তার শ্বশুরবাড়িতে পাঠায়নি। কৈলেশ তাদের সতর্ক করে যে যদি জগু মামলা করে, তাহলে মাসি ও পিসিকে জেল হতে পারে, কারণ স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার আইনগত অধিকার রাখে। মাসি ও পিসি কৈলেশের কথা শুনে খুব চিন্তিত হয়, কিন্তু তারা আহ্লাদিকে জোর করে পাঠাতে রাজি নয়। তারা জানে যে আহ্লাদি শ্বশুরবাড়িতে গেলে তার ভালো থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই, বরং সে সেখানে নির্যাতনের শিকার হতে পারে।
এক রাতে কানাই চৌকিদার এবং গোকুলের পেয়াদারা মাসি ও পিসির বাড়িতে আসে। তারা মাসি ও পিসিকে কাছারিবাড়িতে যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়। কানাই বলে যে দারোগাবাবু তাদের ডেকেছেন এবং যদি তারা না যায়, তাহলে তাদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে। মাসি ও পিসি এই হুমকির মুখেও ভয় পায় না। তারা বঁটি এবং কাটারি হাতে নিয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়। তারা কানাই এবং পেয়াদাদের স্পষ্ট বলে দেয় যে তারা আহ্লাদিকে কখনোই শ্বশুরবাড়িতে পাঠাবে না। মাসি ও পিসির সাহস দেখে কানাই এবং তার দল পিছু হটে যায়।
কানাই এবং পেয়াদাদের হুমকির পর মাসি ও পিসি পাড়ার লোকজনকে ডাকে। তারা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সবাইকে সাহায্যের জন্য ডাকে। পাড়ার লোকজন দ্রুত ছুটে আসে এবং মাসি-পিসির পাশে দাঁড়ায়। এই ঘটনায় মাসি ও পিসি নতুন আশা পায়। তারা বুঝতে পারে যে পাড়ার লোকজন তাদের পাশে আছে এবং তারা আহ্লাদিকে রক্ষা করতে পারবে। তারা রাত জেগে প্রস্তুতি নেয়, যাতে কোনো বিপদ এলে তারা তা মোকাবেলা করতে পারে।