রানার কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা – সুকান্ত ভট্টাচার্য

সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতাটিতে রানার বা ডাক হরকরার জীবন ও সংগ্রামকে কেন্দ্র করে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের কষ্ট, দায়িত্ববোধ ও আশার কথা ফুটে উঠেছে। নিচে রানার কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।

রানার কবিতার মূলভাব

একজন রানার (ডাক হরকরা) রাতের অন্ধকারে ছুটে চলেছে। তার কাঁধে মানুষের চিঠি ও সংবাদের বোঝা। সে রাত-দিন, ঝড়-বৃষ্টি, দুর্গম পথ—কিছুই তাকে থামাতে পারে না। তার দায়িত্ববোধ এতটাই প্রবল যে সে কোনো বাধা মানে না। রানারের জীবন খুব কঠিন। সে ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, কিন্তু তার কাজের প্রতি তার অটুট নিষ্ঠা। তার পরিবারে অভাব, তার প্রিয়া (স্ত্রী বা প্রিয়তমা) একা ঘরে রাত জেগে থাকে, তার ফিরে আসার অপেক্ষায়।

সে হরিণের মতো দ্রুত ও নিঃশব্দে ছুটে চলেছে। তার পথে অনেক গ্রাম, অনেক শহর, অনেক দুঃখ-কষ্ট। কিন্তু সে থামে না। সে জানে, তার কাজ শেষ না হলে মানুষের সুখ-দুঃখের সংবাদ পৌঁছাবে না। সে জানে, ভোর হতেই হবে, সূর্য উঠবেই। কবি রানারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “রানার! সময় হয়েছে নতুন খবর আনার।” অর্থাৎ, রানার শুধু চিঠি নয়, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনার বার্তাও বয়ে নিয়ে যায়।

রানার কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে”
“রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে”
রানার (ডাক হরকরা) রাতের অন্ধকারে ছুটে চলেছে। তার চলার শব্দে ঝুমঝুম করে ঘণ্টা বাজছে।
রানারের হাতে মানুষের চিঠি ও সংবাদের বোঝা।
“রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার”
“দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার”
রানার রাতের অন্ধকারে পথে পথে ছুটে চলেছে। কোনো বাধা বা নিষেধই তাকে থামাতে পারে না।
রানার এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে ছুটে চলেছে। তার কাজের পরিধি বিশাল।
“কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার”রানারের কাজ হলো নতুন খবর আনা। মানুষের চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দেওয়া।
“জানা-অজানার বোঝা আজ তার কাঁধে”রানারের কাঁধে মানুষের জানা-অজানা সুখ-দুঃখের বোঝা। সে এই বোঝা বহন করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়।
“বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে”রানার একটি বোঝাই জাহাজের মতো। তার কাছে মানুষের চিঠি ও সংবাদ ভরা আছে, এবং সে তা নিয়ে ছুটে চলেছে।
“আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।”কবি রানারকে সবকিছু জয় করে ছুটে চলতে বলছেন, আরো দ্রুত, আরো শক্তিতে। 
“তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে সরে যায় বন”রানারের জীবনের স্বপ্ন ও আশা পিছনে পড়ে থাকে, যেমন বন পিছনে সরে যায়। তার কাজের মধ্যে তার নিজের স্বপ্ন ও আশা হারিয়ে যায়।
“আরো পথ, আরো পথ বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ”রানারের সামনে আরো পথ, আরো পথ। পূর্ব দিকের আকাশ লাল হয়ে উঠছে, অর্থাৎ ভোর হতে চলেছে।
“অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিটমিট করে চায়”
“কেমন করে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়”
রাতের তারারা আকাশে মিটমিট করে জ্বলছে। তারা রানারের দৌড়ানোর দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
রানার হরিণের মতো দ্রুত ও নিঃশব্দে ছুটে চলেছে।
“কত গ্রাম কত পথ যায় সরে সরে”
“শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে”
রানার অনেক গ্রাম ও পথ পেরিয়ে যায়।
রানার ভোর হওয়ার আগেই শহরে পৌঁছে যাবে।
“হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন, জোনাকিরা দেয় আলো”
“মাভৈঃ রানার। এখনো রাতের কালো”
রানারের হাতে লণ্ঠন, যা ঠনঠন শব্দ করে। জোনাকিরা আলো দেয়, যা রাতের অন্ধকারে পথ দেখায়।
রানারকে বলা হচ্ছে, ভয় পেয়ো না। এখনো রাতের অন্ধকার আছে, কিন্তু ভোর হতে চলেছে।
“এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে”
“পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে'”
রানার তার জীবনের বহু বছর পিছনে ফেলে দিয়েছে। তার জীবন কষ্টে ভরা, কিন্তু সে তার দায়িত্ব পালন করে।
রানার পৃথিবীর বোঝা বহন করে। সে ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত, কিন্তু তার কাজ শেষ করেছে। সে মানুষের চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দিয়েছে।
“ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে”
“জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে”
রানারের ক্লান্তশ্বাস আকাশ ছুঁয়েছে, মাটি তার ঘামে ভিজে গেছে। 
রানাররা তাদের জীবনের রাতগুলো অল্প দামে বিক্রি করে দিয়েছে।
“অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে”
“ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে”
রানারের জীবন অনেক দুঃখ, বেদনা, অভিমান ও অনুরাগে ভরা।
রানারের প্রিয়া (স্ত্রী বা প্রিয়তমা) একা ঘরে রাত জেগে থাকে, তার ফিরে আসার অপেক্ষায়।
“রানার! রানার! এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?”কবি রানারকে জিজ্ঞাসা করছেন, এই বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
“রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?”কবি রানারকে জিজ্ঞাসা করছেন, রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে? প্রতীকী অর্থে কষ্টের কালিমা দূরীভূত হয়ে সুখের সোনালি আলোর কথা বলা হয়েছে।
“ঘরেতে অভাব: পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া”
“পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া”
রানারের ঘরে অভাব। তার জীবন কষ্টে ভরা। পৃথিবীটা তার কাছে কালো ধোঁয়ার মতো মনে হয়।
রানারের পিঠে টাকার বোঝা, কিন্তু সে সেই টাকা স্পর্শ করে না।
“রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে”
“দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে”
রাত নির্জন, পথে অনেক ভয়, কিন্তু রানার ছুটে চলেছে।
রানারের দস্যুর ভয়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয় সূর্য উঠে যাওয়ার।
“কত চিঠি লেখে লোকে- কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে”মানুষের চিঠিগুলো সুখে-আনন্দে, দুঃখে-শোকে ভরা। এই চিঠিগুলো মানুষের জীবনের নানা অনুভূতি নিয়ে লেখা।
“এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও”
“এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে”
রানারের দুঃখের চিঠি কেউ পড়বে না।
রানারের দুঃখের কথা শহরে ও গ্রামে কেউ জানবে না। 
“দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি”
“এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি”
তারার চোখ দরদে কাঁপে। তারা রানারের দুঃখ বুঝতে পারে।
ভোরের আকাশ রানারকে সহানুভূতির চিঠি পাঠাবে।
“রানার! রানার! কী হবে এ বোঝা বয়ে?”কবি রানারকে জিজ্ঞাসা করছেন, এই বোঝা বয়ে কী হবে?
“রানার! রানার! ভোর তো হয়েছে আকাশ হয়েছে লাল”
“সময় হয়েছে নতুন খবর আনার”
ভোর হয়েছে, আকাশ লাল হয়ে গেছে। 
কবি রানারকে বলছেন, সময় হয়েছে নতুন খবর আনার। 
“শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ ভীরুতা পিছনে ফেলে”
“পৌঁছে দাও এ নতুন খবর, অগ্রগতির ‘মেলে'”
কবি রানারকে বলছেন, সাহসী হতে হবে এবং তার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
রানার নতুন খবর পৌঁছে দিবে। সে সমাজের অগ্রগতির প্রতীক।
“দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি- নেই, দেরি নেই আর”
“ছুটে চলো, ছুটে চলো, আরো বেগে দুর্দম, হে রানার”
কবি বলছেন, প্রভাত দেখা দেবে এখনই। আর দেরি নেই।
ছুটে চলো, আরো দ্রুত, আরো শক্তিতে। 

Related Posts

Leave a Comment