মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধটি একটি গভীর চিন্তামূলক রচনা, যেখানে লেখক শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং মনুষ্যত্বের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। নিচে শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব মূলভাব ও বিষয়বস্তু দেওয়া হল।
শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব মূলভাব
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে লেখক মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে নিচের তলা হলো জীবসত্তা (মৌলিক চাহিদা) এবং ওপরের তলা হলো মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব (আত্মিক ও নৈতিক উন্নতি)। শিক্ষাকে তিনি এই দুই তলার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মই হিসেবে বর্ণনা করেছেন। শিক্ষার দুটি দিক রয়েছে—প্রয়োজনীয় দিক, যা মৌলিক চাহিদা পূরণ করে, এবং অপ্রয়োজনীয় দিক, যা জীবনকে উপভোগ করতে ও মনুষ্যত্বের বিকাশে সাহায্য করে। লেখকের মতে, অন্নবস্ত্রের সমস্যা (খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব) মানুষের মনুষ্যত্বের পথে বাধা সৃষ্টি করে। তাই অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমে মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বের বিকাশ জরুরি। শিক্ষার আসল কাজ জ্ঞান দেওয়া নয়, বরং লোভ, পাপ ও আত্মিক মৃত্যু থেকে মুক্তি দিয়ে মানুষকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী করা। লেখক শেষ পর্যন্ত বলেছেন, শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, মনুষ্যত্বের বিকাশই মানুষের প্রকৃত মুক্তি ও উন্নতির চাবিকাঠি।
শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব বিষয়বস্তু
১. জীবনকে দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা
লেখক বলেছেন, মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘর হিসেবে ভাবা যায়:
- নিচের তলা: এটা হলো আমাদের জীবসত্তা, অর্থাৎ আমাদের মৌলিক চাহিদা—খাওয়া, পরা, বেঁচে থাকা ইত্যাদি। এই তলায় আমরা শুধু নিজের প্রয়োজন মেটানোর চিন্তায় ব্যস্ত থাকি।
- ওপরের তলা: এটা হলো আমাদের মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব, অর্থাৎ আমাদের আত্মিক, নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি। এই তলায় আমরা শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজ ও মানবতার জন্য চিন্তা করি।
শিক্ষা হলো সেই মই, যা আমাদের নিচের তলা (জীবসত্তা) থেকে ওপরের তলা (মনুষ্যত্ব)-এ নিয়ে যায়। শিক্ষা শুধু আমাদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করে না, বরং আমাদেরকে উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
২. শিক্ষার দুটি দিক
শিক্ষার দুটি দিক আছে:
- প্রয়োজনীয় দিক: এটা হলো আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। যেমন—ক্ষুধা নিবারণ, অর্থ উপার্জন ইত্যাদি।
- অপ্রয়োজনীয় দিক: এটা হলো জীবনকে উপভোগ করা, মনের মালিক হওয়া, সুন্দর জিনিস উপলব্ধি করা। লেখকের মতে, এই অপ্রয়োজনীয় দিকই শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
কিন্তু আজকের সমাজে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় দিকেই আটকে আছি। অর্থের পিছনে ছুটতে গিয়ে আমরা মনুষ্যত্বের দিকটি ভুলে যাই। লেখক বলেছেন, “চাই, চাই, আরও চাই”—এই চিন্তায় আমরা আটকে গিয়ে প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য ভুলে যাই।
৩. অন্নবস্ত্রের সমস্যা এবং মুক্তি
লেখক বলেছেন, অন্নবস্ত্রের সমস্যা (খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব) মানুষের জীবনকে জটিল করে তোলে। যারা এই সমস্যায় ভোগে, তারা শুধু টাকা-পয়সা ও প্রয়োজন মেটানোর চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। তাদের পক্ষে মনুষ্যত্বের কথা চিন্তা করা কঠিন।
তাই লেখক বলেছেন, মুক্তি দরকার। মুক্তি মানে শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়, বরং চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা এবং আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা। প্রকৃত মুক্তি পেলে মানুষ তার মনুষ্যত্বের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
৪. মুক্তির জন্য দুটি পথ
লেখক বলেছেন, মানুষের মুক্তি এবং উন্নতির জন্য দুটি জিনিস দরকার:
- অন্নবস্ত্রের সমস্যার সমাধান: অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করে মানুষকে তার মৌলিক চাহিদা থেকে মুক্তি দিতে হবে।
- শিক্ষার মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ: শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে তার আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে হবে।
এই দুটি জিনিস একসাথে কাজ করলে তবেই মানুষের জীবন সত্যিকার অর্থে উন্নত হবে। শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করলে হবে না, আবার শুধু শিক্ষা দিলেও হবে না। দুটির সমন্বয়ই জরুরি।
৫. শিক্ষার প্রকৃত কাজ
লেখক বলেছেন, শিক্ষার আসল কাজ শুধু জ্ঞান দেওয়া নয়, বরং মূল্যবোধ তৈরি করা। শিক্ষা মানুষকে শেখায় কীভাবে লোভ, হিংসা এবং পাপ থেকে দূরে থাকতে হয়। শিক্ষিত মানুষ জানে যে, লোভের ফলে মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। তাই শিক্ষা মানুষকে লোভের ফাঁদে পড়তে দেয় না।
লেখক বলেছেন, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”—এটা শুধু কথা নয়, এটা সত্য। শিক্ষা মানুষকে এই সত্য বুঝতে সাহায্য করে।
৬. শিক্ষা এবং সমাজের ভূমিকা
লেখক বলেছেন, মানুষের উন্নতির জন্য শুধু শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, সমাজকেও সুশৃঙ্খল হতে হবে। তিনি একটি উদাহরণ দিয়েছেন:
- ভারী জিনিস তোলার মতো: কোনো ভারী জিনিস তোলার জন্য নিচ থেকে ঠেলার পাশাপাশি ওপর থেকে টানাও দরকার। তেমনি মানুষের উন্নতির জন্য শিক্ষা (ওপর থেকে টানা) এবং সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা (নিচ থেকে ঠেলা) দুটোই দরকার।
৭. মনুষ্যত্বের আহ্বান
লেখক শেষ পর্যন্ত বলেছেন, মনুষ্যত্বই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। অন্নবস্ত্রের সমস্যা দূর করলেই মানুষ প্রকৃত মুক্তি পাবে না, যদি না তার মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। আবার শুধু মনুষ্যত্বের কথা বললেও হবে না, যদি না মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। তাই দুটোর সমন্বয়ই জরুরি।