সিঁথি কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা- হাসান রোবায়েত

হাসান রোবায়েতের ‘সিঁথি’ কবিতাটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটি নির্মম ও মর্মান্তিক অধ্যায়কে ধারণ করে, যেখানে মানুষের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তির পথ রচিত হয়েছে। নিচে সিঁথি কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা- হাসান রোবায়েত দেয়া হল।

সিঁথি কবিতার মূলভাব

হাসান রোবায়েতের ‘সিঁথি’ কবিতায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪-এর কাহিনী বলা হয়েছে। এই কবিতায় রংপুরে একজন ভাই মারা যাওয়ার ঘটনা দিয়ে শুরু হয়। ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে গিয়ে মানুষ প্রাণ দিয়েছে, নুসরাতেরা (সাধারণ মানুষ) আগুনে পুড়েছে। তরুণরা কারবালার মতো লড়াই করেছে, শাহাদাতের (আত্মত্যাগের) মাধ্যমে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এক মায়ের ছেলে মারা গেছে, সে তার সন্তানের জন্য দরজা খুলে রাখে, কিন্তু ছেলে ফিরে এসেছে রক্তভেজা খাটিয়ায় (শহিদের মরদেহ নিয়ে)। মা মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে ফিরছে, প্রতিদিন তার ছবি দেখে খোঁজে। বাংলাদেশের মাটি শহিদের রক্তে ভেজা, গোরস্থানে শহিদের আত্মা কাঁদে। মায়েরা পুত্রের মিছিলে প্রাণ দিয়েছে, প্রকৃতিও শোকার্ত। কবি বলেন, স্বাধীনতা রক্তের বিনিময়েই আসে। বাংলাদেশের সিঁথিতে (কপালে) রক্তের দাগ লেগে আছে, যা এই দেশের ইতিহাসের অংশ।

সিঁথি কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“ভাই মরল রংপুরে সেই, রংপুরই তো বাংলাদেশ”কবিতাটি শুরু হয়েছে রংপুরের একটি ঘটনা দিয়ে। সেখানে একজন ভাই (সাধারণ মানুষ) মারা গেছেন। রংপুর বাংলাদেশেরই অংশ, কিন্তু সেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
“নুসরাতেরা আগুন দিল, দোজখ যেন ছড়ায় কেশ।”নুসরাত নামের একজন মেয়ে (বা সাধারণ মানুষ) অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু তাকে অত্যাচার করা হয়েছে। এ যেন দোজখের (জাহান্নামের) আগুনের মতো যন্ত্রণা, যা সবাইকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
“কওমি তরুণ দাঁড়ায়া ছিল, কারবালারই ফোরাতে।”তরুণরা দাঁড়িয়ে আছে, যেন তারা কারবালার ফোরাত নদীর তীরে দাঁড়িয়ে। কারবালা হলো ইসলামের ইতিহাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি প্রতীক। তরুণরা ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত।
“শাহাদাতের আগুন দিয়া, খুনির আরশ পোড়াতে।”শাহাদাত (আত্মত্যাগ) হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি পথ। তরুণরা তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অন্যায়কারীদের আরশ (সিংহাসন) পোড়াতে চায়, অর্থাৎ অন্যায়ের শাসনকে ধ্বংস করতে চায়।
“পোলা গেছে মাইয়া গেছে, দুয়ার খুইলা রাখছে মায়।”ছেলে-মেয়ে মারা গেছে, কিন্তু মা এখনও তাদের জন্য দরজা খুলে রাখে, আশা করে যে হয়তো তারা ফিরে আসবে।
“ভাই-বইনে আইছে ফিরা, রক্তভেজা খাটিয়ায়।”পরিবারের সদস্যরা ফিরে এসেছে রক্তভেজা খাটিয়ায় (শহিদের মরদেহ নিয়ে)। এটা তাদের আত্মত্যাগের চিত্র।
“মরা পুতরে কোলে নিয়া, মা ফিরছে অটোতে।”মা তার মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে ফিরছে অটোরিকশায়। এটা একজন মায়ের অসহায়ত্ব ও বেদনার চিত্র।
“রোজ পোলারে খোঁজে অহন, আইডি কার্ডের ফটোতে।”মা এখন প্রতিদিন তার ছেলের ছবি (আইডি কার্ডের ফটো) দেখে তাকে খোঁজে। এটা তার শোক ও ভালোবাসার প্রকাশ।
“চক্ষু দিল পা-ও দিল, সারা বাংলায় কাফন শ্যাষ।”শহিদরা তাদের চোখ ও পা (জীবন) দিয়েছে, সারা বাংলায় এখন শুধু কাফনের ছায়া (মৃত্যুর ছবি)।
“গোরস্থানে কান্দে শহিদ, পঙ্গু যেন হয় না দ্যাশ।”গোরস্থানে শহিদের আত্মা কাঁদে, কিন্তু তাদের আত্মত্যাগে দেশ যেন ধ্বংস না হয়, তাই কবি আশঙ্কা করেছেন ।
“মায়ের ওড়না বাইন্ধা মাথায়, পুত মিছিলে হারাইল প্রাণ।”মায়েরা তাদের ওড়না মাথায় বেঁধে পুত্রের মিছিলে অংশ নিয়েছে এবং প্রাণ দিয়েছে। এটা তাদের সাহস ও ভালোবাসার প্রকাশ।
“ঘাস কান্দে গাছ কান্দে, কান্দে বাঁশের গোরস্থান।”প্রকৃতিও যেন কাঁদছে—ঘাস, গাছ, বাঁশের গোরস্থান সবাই শোকার্ত।
“খোদার আরশ কাঁইপা ওঠে, শুইনা বাপের হাহাকার।”আল্লাহর আরশ (সিংহাসন) কেঁপে উঠেছে বাবার হাহাকার শুনে। এটা মানুষের বেদনার গভীরতা প্রকাশ করে।
“একটা মানুষ মারার লাগি, কয়টা গুলি লাগে ছার?”কবি প্রশ্ন তোলেন, একজন মানুষকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে? এটা অন্যায়ের নির্মমতা ও হিংস্রতার প্রতি একটি তীব্র প্রতিবাদ।
“লাশের ভিতর লাশ ডুইবা যায়, রাতের হাওয়ায় কিসের লাল।”লাশের উপর লাশ জমে যায়, রাতের বাতাসে লাল রক্তের গন্ধ ছড়ায়। এটা যুদ্ধ বা সংঘাতের ভয়াবহতা প্রকাশ করে।
“সারা আকাশ ছাইয়া আছে, কোন শহিদের গায়ের শাল।”আকাশ যেন শহিদের গায়ের শাল (চাদর) হয়ে গেছে। এটা শহিদের আত্মত্যাগের মহিমা প্রকাশ করে।
“চিরকালই স্বাধীনতা, আসে এমন রীতিতে।”কবি বলেন, স্বাধীনতা এমনই আসে—রক্তের বিনিময়ে। এটা স্বাধীনতার মূল্য ও সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
“কত রক্ত লাইগা আছে, বাংলাদেশের সিঁথিতে।”বাংলাদেশের সিঁথিতে (কপালে) রক্তের দাগ লেগে আছে, যা এই দেশের ইতিহাসের অংশ। এটা দেশের মানুষের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতীক।

Related Posts

Leave a Comment