সুখ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা – কামিনী রায়

কামিনী রায়ের ‘সুখ’ কবিতাটি জীবনের এক গভীর সত্য তুলে ধরে, যেখানে কবি সুখের প্রকৃতি এবং তার অর্জনের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। কবিতাটি একটি জীবনদর্শন, যেখানে দুঃখ, সংগ্রাম, ত্যাগ ও সমাজের কল্যাণের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নিচে সুখ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।

সুখ কবিতার মূলভাব

কামিনী রায়ের “সুখ” কবিতাটির মাধ্যমে কবি মানুষের জীবনের দুঃখ ও হতাশাকে তুলে ধরেছেন। অনেকেই মনে করেন, জীবন শুধুই কষ্টের, এবং সুখ বলে কিছু নেই। কিন্তু কবি এই হতাশাকে মানতে নারাজ। তিনি বলেছেন, মানুষের জীবনের লক্ষ্য শুধু সুখ খোঁজা নয়, বরং আরও মহৎ কিছু। জীবন শুধুই দুঃখময় নয়, এখানে সুখও আছে, কিন্তু তা পেতে হলে সংগ্রাম করতে হবে। কবি সংসারকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রের সাথে তুলনা করেছেন। কবির মতে, প্রকৃত সুখ পেতে হলে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। অন্যের জন্য ত্যাগ করার মধ্যেই জীবনের প্রকৃত অর্থ নিহিত। শুধু নিজের সুখের জন্য কাঁদলে বা হতাশ হলে চলবে না। পৃথিবীতে কেউ শুধু নিজের জন্য আসেনি। প্রতিটি মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আমরা সবাই একে অন্যের জন্য। অন্যের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে, অন্যের জন্য ত্যাগ করাই হল জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য।

সুখ কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?-“কবি প্রশ্ন করছেন, পৃথিবীতে কি সুখ নেই? এই প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি মানুষের জীবনে সুখের অভাব এবং হতাশাকে তুলে ধরেছেন। অনেকেই মনে করেন, জীবন শুধুই দুঃখ আর কষ্টের।
“এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?”কবি বলছেন, এই পৃথিবী কি শুধুই দুঃখ আর বেদনায় ভরা? মানুষ কি শুধুই কষ্ট পেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে জীবন কাটায়?
“যাতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে কেবলি কি নর জনম লয়?”কবি প্রশ্ন করছেন, মানুষ কি শুধুই যন্ত্রণা ভোগ করে, কাঁদে এবং মারা যায়? এই লাইনে জীবনের কষ্ট ও দুঃখের দিকটি আরও গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
“বল ছিন্ন বীণে, বল উচ্চৈঃস্বরে-“কবি বলছেন, ছিন্ন বীণার মতো ভাঙা কণ্ঠে, কিন্তু জোরে জোরে বলো। এখানে ‘ছিন্ন বীণে’ বলতে ভাঙা মন বা হতাশাকে বোঝানো হয়েছে, কিন্তু কবি বলছেন, তবুও জোরে জোরে কথা বলো, হতাশাকে জয় করো।
“না, না, না, মানবের তরে আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর।”না, মানুষের জন্য শুধু দুঃখ নয়। মানুষের জীবনের লক্ষ্য আরও মহৎ, এবং সুখও আরও উচ্চতর। অর্থাৎ, জীবনের উদ্দেশ্য শুধু সুখ খোঁজা নয়, বরং আরও বড় কিছু অর্জন করা।
“সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে।”সৃষ্টিকর্তা মানুষকে শুধু কাঁদানোর জন্য সৃষ্টি করেননি। অর্থাৎ, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য শুধু দুঃখ ভোগ করা নয়।
“কার্যক্ষেত্র ঐ প্রশস্ত পড়িয়া সমর-অঙ্গন সংসার এই।”এই পৃথিবীর বিশাল কাজের মাঠ, যেখানে মানুষকে সংগ্রাম করতে হবে। সংসারকে তিনি একটি যুদ্ধক্ষেত্রের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে মানুষকে লড়াই করে সুখ অর্জন করতে হবে।
“যাও বীরবেশে কর গিয়া রণ; যে জিনিবে সুখ লভিবে সে-ই।”বীরের মতো সাজো এবং এই যুদ্ধে নামো। যারা এই সংগ্রামে জয়ী হবে, তারাই প্রকৃত সুখ পাবে। অর্থাৎ, সুখ পেতে হলে সংগ্রাম করতে হবে।
“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও।”অন্যের জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে, জীবন উৎসর্গ করো। প্রকৃত সুখ লাভ করার জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে অন্যের জন্য কাজ করতে হবে।
“তার মতো সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”অন্যের জন্য ত্যাগ করার মতো সুখ আর কোথাও নেই। নিজের কথা ভুলে গিয়ে অন্যের জন্য কাজ করাই হল প্রকৃত সুখ।
“পরের কারণে মরণেও সুখ, ‘সুখ’ ‘সুখ’ করি কেঁদ না আর।”অন্যের জন্য মরতেও সুখ আছে। শুধু নিজের সুখের জন্য কাঁদলে বা হতাশ হলে চলবে না। কারণ, যত বেশি হতাশা, তত বেশি মনের বোঝা বাড়ে।
“যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে ততই বাড়িবে হৃদয় ভার।”কবি বলছেন, যত বেশি তুমি কাঁদবে বা হতাশ হবে, তত বেশি তোমার মনের বোঝা বাড়বে। অর্থাৎ, হতাশা কখনও সুখ দেয় না।
 “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে।”পৃথিবীতে কেউ শুধু নিজের জন্য আসেনি। আমরা সবাই অন্যের জন্য আছি। প্রতিটি মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল।
“সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।”আমরা সবাই একে অন্যের জন্য। অন্যের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে, অন্যের জন্য ত্যাগ করাই হল জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। এই লাইনটি কবিতার মূল বার্তা প্রকাশ করে।

Related Posts

Leave a Comment