সোনার তরী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার তরী” কবিতাটিতে ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতীক হিসেবে ধান কাটার দৃশ্য এবং সোনার তরীর মাধ্যমে সময়ের প্রবাহ ও জীবনের মূল্যবোধ ফুটে উঠেছে। নিচে সোনার তরী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন দেওয়া হল।

সোনার তরী কবিতার মূলভাব

বর্ষার দিনে নদীতে পানি উপচে পড়ছে। নদীর ধারে এক কৃষক তার সোনার ধান নিয়ে চিন্তিত। নদীর স্রোত খুব তীব্র। হঠাৎ সে দেখে একটি নৌকায় একজন মাঝি। কৃষকের মনে হয়, সে এই মাঝিকে চেনে। নৌকাটি কোনো দিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যায়, এবং কৃষক তাকে ডাকে। মাঝি নৌকা নিয়ে কূলেতে এসে কৃষক তার সমস্ত সোনার ধান তরীতে তুলে দেয়। কিন্তু ছোট নৌকাতে কৃষকের নিজের জন্য আর জায়গা থাকে না। মাঝি তরী নিয়ে চলে যায়, আর কৃষক শূন্য নদীর তীরে একা পড়ে থাকে।

সারাজীবন কঠোর পরিশ্রম করে বাড়ি, গাড়ি, সঞ্চয়, বা আপনার সৃষ্টি (যেমন লেখা, গান, শিল্প) অর্জন করেছেন। কিন্তু একদিন সময় এসে যায়, এই সবকিছুই সময়ের হাতে তুলে দিতে হবে। আপনি নিজে রয়ে যাবেন শূন্য হাতে, কিন্তু আপনার সৃষ্টি বা অর্জন বেঁচে থাকবে। এই কবিতাটি আমাদের শেখায় যে, জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আমাদের শ্রম ও সৃষ্টি চিরস্থায়ী। আমরা হয়তো চলে যাব, কিন্তু আমাদের কাজ ও সৃষ্টি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে।

সোনার তরী কবিতার লাইন বাই লাইন ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।”
আকাশে মেঘ গর্জন করছে, এবং প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। নদীর কূলে একা বসে থাকা কৃষকের মনে কোনো ভরসা নেই।
জীবনে যেমন বৃষ্টি ও মেঘ আসে, তেমনি আমাদের জীবনে দুঃখ, চিন্তা, ও অনিশ্চয়তা আসে।
“রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হলো সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা-“
কবি কৃষকের শ্রম ও ফসলের বর্ণনা দিয়েছেন। ধান কাটা শেষ হয়েছে, এবং ধান ভরার পাত্রগুলো রাশি রাশি হয়ে আছে। নদী পানিতে পরিপূর্ণ, এবং তার স্রোত খুব ধারালো ও শক্তিশালী। 
আমরা জীবনে অনেক শ্রম দিয়ে কিছু অর্জন করি, কিন্তু সেই অর্জন শেষ পর্যন্ত সময়ের হাতে চলে যায়।
“কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা ॥”ধান কাটতে কাটতেই বর্ষা এসে গেল। এটি শুধু প্রকৃতির পরিবর্তনের বর্ণনা নয়, বরং জীবনের অনিশ্চয়তা ও সময়ের গতির প্রতীক।
“একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা-“তার একটি ছোট ধানখেত আছে, এবং তিনি একা।
জীবনে আমরা অনেক সময় একা হয়ে যাই। আমাদের অর্জন ও সংগ্রামের মাঝেও আমরা একাকীত্ব অনুভব করি।
“চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।”চারিদিকে নদীর বাঁকা জল খেলছে। এটি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, বরং জীবনের অনিশ্চয়তা ও পরিবর্তনের প্রতীক। নদীর জল হলো সময়ের স্রোত, যা আমাদের চারিদিকে ঘিরে থাকে।
“পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা-“
কবি পরপারের গ্রামের একটি সুন্দর চিত্র এঁকেছেন। গ্রামটি গাছের ছায়ায় মাখানো, এবং মেঘে ঢাকা।
জীবনে আমরা দূরের সুখ ও শান্তির স্বপ্ন দেখি, কিন্তু তা আমাদের নাগালের বাইরে থাকে। আমরা তা দেখতে পাই, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে পারি না।
“এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা ।।”এপারে তার ছোট ধানখেত আছে, এবং তিনি একা।
এটি শুধু কৃষকের একাকীত্ব নয়, বরং মানব জীবনের একাকীত্ব ও সংগ্রামের প্রতীক।
“গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।”
তরীতে একজন মাঝি গান গাইতে গাইতে তরী চালাচ্ছে। তরী ও মাঝিকে দেখে মনে হয়, কবি তাকে চেনেন, কিন্তু নিশ্চিত নন।
জীবনে সময় বা ভাগ্য আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, এবং আমরা তাকে চিনতে পারি না।
“ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে-“
তরীটি ভরা পালে চলে যায়, এবং কোনো দিকে তাকায় না। ঢেউগুলো দুধারে ভাঙছে, কিন্তু তরীটি নির্বিকারভাবে চলে যায়।
সময় বা ভাগ্য খুব দ্রুত চলে যায়, এবং তার সামনে আমরা অসহায়। সময়ের স্রোত আমাদের সবকিছু নিয়ে চলে যায়, কিন্তু সে আমাদের দিকে তাকায় না।
“দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে ।।”তরী ও মাঝিকে দেখে মনে হয়, কৃষক তাকে চেনেন। 
“ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।”
কৃষক মাঝিকে জিজ্ঞাসা করছেন, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?” এবং তরীকে কূলেতে ভিড়ানোর জন্য অনুরোধ করছেন।
জীবনে আমরা সবাই কোথায় যাচ্ছি, তা আমরা জানি না। আমরা সময় বা ভাগ্যকে ডাকি, কিন্তু সে আমাদের অনুরোধ শুনে কিনা তা আমরা জানি না।
“যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও-
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কুলেতে এসে ॥”
কৃষক (কবি) মাঝিকে বলছেন, “তুমি যেখানে খুশি যাও, যাকে খুশি দাও। শুধু আমার সোনার ধান নিয়ে যাও।”
জীবনে যা অর্জন করি, সব সময়ের স্রোতে তুলে দিতে হয়। আমরা নিজেরা রয়ে যাই শূন্য হাতে, কিন্তু আমাদের সৃষ্টি বা অর্জন বেঁচে থাকে।
“যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে- আর নাই, দিয়েছি ভরে।”
মাঝি যত চায়, তত নিতে পারে। কৃষক তার সবকিছু তরীতে তুলে দিয়েছে, এবং তার আর কিছু নেই। 
আমরা জীবনে যা অর্জন করি, সব সময়ের স্রোতে তুলে দিতে হয়। আমরা নিজেরা রয়ে যাই শূন্য হাতে।
“এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে-“
তিনি এতকাল নদীর কূলে যা জমিয়েছিলেন, সব তুলে দিয়েছেন।
জীবনে আমরা যা কিছু অর্জন করি, সব সময়ের স্রোতে তুলে দিতে হয়। আমরা নিজেরা রয়ে যাই শূন্য হাতে।
“এখন আমারে লহো করুণা করে ।”কবি মাঝিকে অনুরোধ করছেন, “এখন আমাকে করুণা করে নিয়ে যাও।”
জীবনের শেষ পর্যায়ে আমরা সবকিছু তুলে দিয়ে শুধু করুণা চাই।
“ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।”
কৃষকের সোনার ধানে তরী ভরে গেছে, কিন্তু তার নিজের জন্য জায়গা নেই।
জীবনে আমরা অনেক কিছু অর্জন করি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের জন্য জায়গা থাকে না। আমরা রয়ে যাই শূন্য হাতে।
“শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি-“
আকাশে ঘন মেঘ ঘুরছে, এবং তিনি শূন্য নদীর তীরে পড়ে আছেন। 
জীবনের শেষ পর্যায়ে আমরা একা হয়ে যাই, এবং আমাদের মনে অপূর্ণতার বেদনা থাকে।
 “যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী ॥”এই লাইনে কবি বলেছেন, যা ছিল, সব নিয়ে গেল সোনার তরী।
জীবনে আমরা যা অর্জন করি, সব সময়ের স্রোতে চলে যায়। আমরা নিজেরা রয়ে যাই শূন্য হাতে।

Related Posts

Leave a Comment