আফ্রিকা কবিতার বিষয়বস্তু ও ব্যাখ্যা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটিতে আফ্রিকার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঔপনিবেশিক শোষণের বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। কবিতাটিতে আফ্রিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তার আদিম রহস্য এবং ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা তার লুণ্ঠন ও অপমানের চিত্র ফুটে উঠেছে। নিচে আফ্রিকা কবিতার বিষয়বস্তু ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।

আফ্রিকা কবিতার বিষয়বস্তু

আফ্রিকা কবিতায় কবি আফ্রিকা মহাদেশের কথা বলেছেন। কবির মতে, সৃষ্টির শুরুতে যখন সৃষ্টিকর্তা নিজের কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন, তখন তিনি আফ্রিকাকে পৃথক করে দেন। আফ্রিকা তখন থেকে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে শুরু করে। প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এই মহাদেশটি ধীরে ধীরে নিজের শক্তি ও রহস্য গড়ে তোলে। কিন্তু এর আদিম রূপ ও কালো রঙের জন্য সভ্য সমাজ আফ্রিকাকে উপেক্ষা করে।

তারপর পশ্চিমের তথাকথিত সভ্য দেশগুলো আফ্রিকার দিকে লোভী নজর দেয়। তারা আফ্রিকার সম্পদ লুট করতে আসে এবং সেখানকার মানুষদের ক্রীতদাস বানায়। তাদের অত্যাচারে আফ্রিকার মাটি রক্ত ও অশ্রুতে ভরে যায়। কবি এই অত্যাচারের চিত্র খুব বেদনাদায়কভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

কবিতার শেষে কবি আফ্রিকার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, সভ্যতার নামে যারা এই অত্যাচার করেছে, তাদের অপরাধের জন্য আফ্রিকা যেন ক্ষমা করে। কবি বিশ্বাস করেন, আফ্রিকার সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাশীলতাই সত্যিকার সভ্যতার বার্তা দেবে।

সহজ কথায়, এই কবিতায় কবি আফ্রিকার দুঃখ ও যন্ত্রণার কথা বলেছেন এবং ঔপনিবেশিক শক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কবি চেয়েছেন, আফ্রিকার মতো শোষিত মানুষদের কথা সবাই যেন বুঝতে পারে এবং তাদের প্রতি সম্মান দেখায়।

আফ্রিকা কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
অষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে”
সৃষ্টির শুরুতে, যখন সব কিছু অস্থির ও বিশৃঙ্খল ছিল, সৃষ্টিকর্তা নিজের কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি বারবার নতুন কিছু তৈরি করছিলেন আবার ভেঙেও ফেলছিলেন।
“নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে”
সৃষ্টিকর্তা নতুন নতুন জিনিস তৈরি করছিলেন, কিন্তু সেগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে সেগুলো ভেঙে ফেলছিলেন। এই সময়টা ছিল খুবই অস্থির, যখন তিনি বারবার মাথা নাড়ছিলেন (যেন হতাশায় বা ভাবনায়)।
“বুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে”
সমুদ্রের শক্তিশালী হাত (বা ঢেউ) পৃথিবীর বুক থেকে আফ্রিকাকে আলাদা করে নিল। এটা যেন প্রকৃতির একটি ঘটনা, যেখানে সমুদ্রের জোরেই আফ্রিকা পৃথক হয়ে গেল।
“ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা-
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়”
সমুদ্রের হাত আফ্রিকাকে পৃথিবীর বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং তাকে ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘিরে ফেলল। এই জঙ্গল যেন আফ্রিকাকে রক্ষা করার জন্য পাহারা দিচ্ছিল।
“কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি”
আফ্রিকাকে এমন জায়গায় রাখা হলো যেখানে আলো খুব কম পৌঁছায়, যেন গোপন একটি ঘরে। সেখানে আফ্রিকা নিভৃতে (একা) নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে লাগল।
“সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য
চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত”
আফ্রিকা সেই নিভৃত জায়গায় প্রকৃতির রহস্য বুঝতে শুরু করল। জল, মাটি, আকাশের সংকেতগুলো সে বুঝতে চেষ্টা করল। এগুলো ছিল খুবই জটিল ও দুর্বোধ্য।
“প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল, তোমার চেতনাতীত মনে”
প্রকৃতির এমন কিছু জাদু, যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না, তা আফ্রিকার মনে এক ধরনের মন্ত্রের মতো কাজ করছিল। এই জাদু তার অবচেতন মনে প্রভাব ফেলছিল।
“বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে”
আফ্রিকা তার ভয়ঙ্কর রূপ দিয়ে ভয়কে বিদ্রূপ করছিল। সে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলছিল যেন ভয় তার কাছে কিছুই না।
“শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র ক’রে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়”
আফ্রিকা চাইছিল ভয়কে হার মানাতে। সে নিজেকে খুব শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর করে তুলছিল, যাতে কেউ তাকে সহজে আক্রমণ করতে না পারে।
“তান্ডবের দুন্দুভিনিনাদে।
হায় ছায়াবৃতা”
আফ্রিকা তার শক্তির নাচ (তান্ডব) ও ডামফের শব্দে (দুন্দুভিনিনাদ) সবাইকে জানান দিচ্ছিল যে সে কত শক্তিশালী। কিন্তু হায়, এই শক্তিশালী আফ্রিকা ছিল ছায়ায় ঢাকা, অর্থাৎ তার আসল রূপ কেউ দেখতে পায়নি।
“কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ”
আফ্রিকার কালো রঙ ও রহস্যময়তার জন্য তার মানবিক রূপটা কেউ চিনতে পারেনি। সবাই তাকে শুধু একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা হিসেবেই দেখত।
“উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে”
সভ্য সমাজ আফ্রিকাকে উপেক্ষা করত। তারপর পশ্চিমের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো লোহার হাতকড়ি নিয়ে আফ্রিকায় এলো। তারা আফ্রিকার মানুষদের ধরে নিয়ে যেতে শুরু করল।
“নখ যাদের তীক্ষ্ম তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল”
এই ঔপনিবেশিক শক্তির নখগুলো নেকড়ে বাঘের থেকেও তীক্ষ্ণ ছিল। তারা মানুষ ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দল বেঁধে এসেছিল। তাদের অত্যাচার ছিল খুবই ভয়ঙ্কর।
“গর্বে যারা অন্ধ তোমার সুর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ”
যারা নিজেদের নিয়ে এতই গর্বিত যে তারা আফ্রিকার অন্ধকার জঙ্গলকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই তথাকথিত সভ্য মানুষেরা আসলে বর্বর ও লোভী।
“নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে”
তারা তাদের লজ্জাহীন ও অমানুষিক কাজগুলো প্রকাশ্যে করে দেখাল। আফ্রিকার মানুষের কান্না, যার কোনো ভাষা নেই, তা জঙ্গলের পথে ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ল।
“পঙ্কিল হলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়”
আফ্রিকার মানুষের রক্ত ও অশ্রুতে মাটির ধুলো কর্দমাক্ত হয়ে গেল। ঔপনিবেশিক দস্যুদের জুতোর তলায় এই মাটি পিষ্ট হলো।
“বীভৎস কাদার পিন্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।”
তাদের জুতোর তলায় আফ্রিকার মাটি ভয়ঙ্কর কাদায় পরিণত হলো। এই কাদা আফ্রিকার অপমানিত ইতিহাসে চিরকালের জন্য চিহ্ন রেখে গেল।
“সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা”
এই অত্যাচার চলার সময়ও পশ্চিমের দেশগুলোতে মন্দিরে পূজার ঘণ্টা বাজছিল। তারা ঈশ্বরের নাম নিচ্ছিল, কিন্তু আফ্রিকায় তারা অত্যাচার চালাচ্ছিল।
“সকালে সন্ধ্যায় দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে:”
সকাল-সন্ধ্যায় তারা দয়াময় ঈশ্বরের নাম নিচ্ছিল, আর শিশুরা মায়ের কোলে খেলছিল। কিন্তু তাদের এই শান্তির পিছনে লুকিয়ে ছিল আফ্রিকার মানুষের দুঃখ।
“কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল
সুন্দরের আরাধনা ।।”
পশ্চিমের কবিরা সুন্দরের গান গাইছিল, কিন্তু তাদের এই সুন্দরের পিছনে ছিল আফ্রিকার মানুষের যন্ত্রণা।
“আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস”
এখন পশ্চিমের দিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। ঝড়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেন সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে।
“যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল-
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল”
গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এসেছে, অর্থাৎ অত্যাচারীরা আবার সক্রিয় হয়েছে। তারা অশুভ ধ্বনিতে দিনের শেষের কথা ঘোষণা করছে।
“এসো যুগান্তের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে”
কবি আহ্বান করছেন, যুগের শেষে এসো এবং সন্ধ্যার শেষ আলোয় দাঁড়াও।
“দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
বলো ‘ক্ষমা করো’-“
অপমানিত আফ্রিকার দরজায় দাঁড়াও এবং তাদের কাছে ক্ষমা চাও।
“হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।।”
এই হিংস্রতার মধ্যে ক্ষমা চাওয়াটাই যেন সভ্যতার শেষ পবিত্র বার্তা হয়।

Related Posts

Leave a Comment