মানুষ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা – কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতাটিতে নজরুল মানুষের মর্যাদা ও সাম্যের কথা বলেছেন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের সমালোচনা করেছেন। নিচে মানুষ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।

মানুষ কবিতার মূলভাব

কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতার শুরুতে নজরুল ঘোষণা করেন যে, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, এবং ধর্ম, জাতি, দেশ-কালের বিভেদ সবই মানুষের তৈরি। তিনি দুটি ঘটনার মাধ্যমে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মানুষের প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন। প্রথম ঘটনায়, একজন ক্ষুধার্ত মানুষ মন্দিরে খাবারের জন্য আসে, কিন্তু পূজারী তাকে সাহায্য না করে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেয়। দ্বিতীয় ঘটনায়, একজন মুসাফির মসজিদে খাবারের জন্য আসে, কিন্তু মোল্লা তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।

কবিতার শেষে তিনি ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং সব দ্বার খোলা রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, খোদার ঘরে কেউ তালা লাগাতে পারে না, এবং মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াই সবচেয়ে বড় ধর্ম। নজরুলের এই কবিতায় মানুষের মর্যাদা ও সাম্যের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

মানুষ কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“গাহি সাম্যের গান –
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”
কবি শুরু করেছেন সাম্যের গান গেয়ে। তিনি বলেছেন, মানুষের চেয়ে বড় বা মহান কিছুই নেই। মানুষই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং ধর্ম, জাতি, বর্ণ বা সম্পদের চেয়ে মানুষের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে।
“নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
কবি বলেছেন, মানুষের মধ্যে দেশ, কাল বা পাত্রের কোনো ভেদ নেই। সব ধর্ম ও জাতির মানুষ একে অপরের ভাই। সব দেশে এবং সব সময়ে মানুষ একে অপরের আত্মীয়।
“নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি”দেশ, কাল, পাত্র, ধর্ম, জাতি ইত্যাদির কোনো বিভেদ নেই। সব মানুষই একে অপরের সমান।
“সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি”সব দেশে এবং সব সময়ে মানুষই একে অপরের আত্মীয় বা জ্ঞাতি।
“পূজারী, দুয়ার খোলো –
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে, পূজার সময় হলো।”
এখানে ক্ষুধার্ত মানুষকে ‘ক্ষুধার ঠাকুর’ বলা হয়েছে। কবি বলেছেন, ক্ষুধার্ত মানুষ মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, এখন তার পূজা করার সময় হয়েছে। অর্থাৎ, ক্ষুধার্ত মানুষের সাহায্য করাই প্রকৃত পূজা।
“স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয়।”
পূজারী স্বপ্ন দেখে যে দেবতার আশীর্বাদে সে রাজা-মহারাজা হয়ে যাবে। তাই সে মন্দির খোলে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধি, ক্ষুধার্ত মানুষের সাহায্য নয়।
“জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কণ্ঠ ক্ষীণ –
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনি তো সাত দিন!”
একজন ক্ষুধার্ত পথিক, যার পরনে জীর্ণ কাপড়, শরীর শীর্ণ এবং ক্ষুধায় তার কণ্ঠস্বর দুর্বল। সে মন্দিরের দরজায় এসে বলছে, “দরজা খোলো, আমি সাত দিন ধরে কিছু খাইনি।”
“সহসা বন্ধ হলো মন্দির, ভূখারি ফিরিয়া চলে,
তিমিররাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!”
পূজারী ক্ষুধার্ত মানুষকে সাহায্য না করে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ক্ষুধার্ত মানুষ নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। তার ক্ষুধার যন্ত্রণা অন্ধকার রাতের মতো তাকে গ্রাস করে।
“ভূখারি ফুকারি’ কয়,
‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়।”
ক্ষুধার্ত মানুষ চিৎকার করে বলে, “এই মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা তোমার নয়।” অর্থাৎ, ধর্মীয় নেতারা ধর্মের নামে শুধু নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করে, মানুষের সাহায্য করে না।
“মসজিদে কাল শিরনি আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি।”
মসজিদে প্রচুর পরিমাণে খাবার (শিরনি, গোশত, রুটি) রয়েছে। মোল্লা সাহেব সেই খাবারের কথা ভেবে হাসছেন, কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষকে তা দিচ্ছেন না।
“এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন
বলে, ‘বাবা, আমি ভুখা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন।”
ছেঁড়া কাপড় পরা একজন ক্ষুধার্ত মুসাফির (পথিক) মসজিদে এসে বলে, “বাবা, আমি সাত দিন ধরে কিছু খাইনি।” তার শরীরে ক্ষুধার যন্ত্রণা স্পষ্ট।
“তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা – ‘ভ্যালা হলো দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে। নমাজ পড়িস বেটা?”
মোল্লা রেগে গিয়ে বলে, “এ কী সমস্যা! তুমি ক্ষুধার্ত? তাহলে গো-ভাগাড়ে (ময়লা ফেলার স্থান) গিয়ে মরো। তুমি কি নামাজ পড়ো?” অর্থাৎ, মোল্লা ক্ষুধার্ত মানুষকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।
“ভূখারি কহিল, ‘না বাবা।’ মোল্লা হাঁকিল – ‘তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ!’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা।”
ক্ষুধার্ত মানুষ বলে, “না বাবা, আমি নামাজ পড়ি না।” মোল্লা তাকে গালি দিয়ে তাড়িয়ে দেয় এবং মসজিদের দরজা বন্ধ করে দেয়।
“ভুখারি ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে –
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করনি প্রভু।”
ক্ষুধার্ত মুসাফির ফিরে যেতে যেতে বলে, “আমি আশি বছর ধরে কখনো তোমাকে ডাকিনি, কিন্তু তুমি আমার ক্ষুধার অন্ন বন্ধ করনি।” অর্থাৎ, ঈশ্বর কখনো ক্ষুধার্ত মানুষকে সাহায্য করতে বাধা দেননি, কিন্তু ধর্মীয় নেতারা তা করে।
“তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি।
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।”
কবি বলেছেন, মসজিদ ও মন্দিরে মানুষের দাবি পূরণ হয় না। মোল্লা ও পুরোহিতরা ধর্মের নামে শুধু নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করে এবং মানুষের জন্য দরজা বন্ধ করে দেয়।
“কোথা চেঙ্গিস, গজনি মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার!”
কবি চেঙ্গিস খান, গজনির মামুদ এবং কালাপাহাড়ের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের ডাকেন। তিনি তাদের বলছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বন্ধ দরজা ভেঙে ফেলতে, কারণ খোদার ঘরে তালা দেওয়ার অধিকার কারো নেই।
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!”
কবি প্রশ্ন করেন, খোদার ঘরে কে তালা লাগায়? তিনি বলেন, সব দরজা খোলা রাখতে হবে এবং হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে বন্ধ দরজা ভেঙে ফেলতে হবে।
“হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!”
কবি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্বোধন করে বলেন, “হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়ে ভণ্ডরা শুধু নিজের স্বার্থের জয়গান গায়।” অর্থাৎ, ধর্মীয় নেতারা শুধু নিজের লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে।

Related Posts

Leave a Comment