গোলাম মোস্তফার “জীবন বিনিময়” কবিতাটিতে মোগল সম্রাট বাবর ও তাঁর পুত্র হুমায়ুনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, যেখানে বাবর পুত্রের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করার প্রস্তুতি নেন। নিচে জীবন বিনিময় কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।
জীবন বিনিময় কবিতার মূলভাব
জীবন বিনিময় কবিতাটি মোগল সম্রাট বাবর এবং তাঁর পুত্র হুমায়ুনের একটি ঘটনা নিয়ে লেখা। হুমায়ুন খুবই অসুস্থ, তাঁর জীবন বিপন্ন। সম্রাট বাবর খুবই চিন্তিত এবং দুঃখিত, কারণ তাঁর পুত্রের জীবন বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। সব চিকিৎসক ও হেকিমরা হুমায়ুনের রোগ সারানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। হুমায়ুনের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে, এবং মনে হচ্ছে তাঁর মৃত্যু আসন্ন। এমন সময় এক দরবেশ (ধর্মীয় ব্যক্তি) এসে বাবরকে বলেন, “সুলতান, যদি আপনি আপনার সবচেয়ে প্রিয় ধন আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করেন, তাহলে আল্লাহ হুমায়ুনের জীবন বাঁচাবেন।” বাবর বুঝতে পারেন যে, মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ধন হলো তার নিজের জীবন। তাই তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এবং বলেন, “হে আল্লাহ, আমার প্রাণ নাও, কিন্তু আমার পুত্র হুমায়ুনের জীবন বাঁচাও।”
বাবরের এই আত্মত্যাগের প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন। হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে, কিন্তু বাবর নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন। তবে কবিতার শেষে বলা হয়েছে যে, বাবরের এই আত্মত্যাগ তাঁকে অমর করে রেখেছে। তিনি মারা গেছেন, কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগ ও পিতৃস্নেহের গল্প চিরকাল মানুষের মনে থাকবে।
জীবন বিনিময় কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে, নিদ নাহি চোখে তাঁর- পুত্র তাঁহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে না এবার আর!“ | বাবরের পুত্র হুমায়ুন খুবই অসুস্থ। তাঁর অবস্থা এতটাই খারাপ যে, মনে হচ্ছে এবার তিনি বাঁচবেন না। বাবর এই ভেবে আরও বেশি ভেঙে পড়েছেন। তিনি এতটাই দুঃখে আছেন যে, তাঁর চোখে ঘুম নেই। তিনি সারাক্ষণ কাঁদছেন এবং অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। |
“চারিধারে তার ঘনায়ে আসিছে মরণ-অন্ধকার।“ | হুমায়ুনের চারপাশে মৃত্যুর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। অর্থাৎ, তাঁর মৃত্যু খুব কাছাকাছি। |
“রাজ্যের যত বিজ্ঞ হেকিম কবিরাজ দরবেশ এসেছে সবাই, দিতেছে বসিয়া ব্যবস্থা সবিশেষ,“ | রাজ্যের সব বিখ্যাত চিকিৎসক, কবিরাজ এবং ধর্মীয় ব্যক্তিরা (দরবেশ) হুমায়ুনের রোগ সারানোর চেষ্টা করছেন। |
“সেবাযত্নের বিধিবিধানের ত্রুটি নাহি এক লেশ। তবু তাঁর সেই দুরন্ত রোগ হটিতেছে নাক হায়,“ | হুমায়ুনের সেবা-যত্নে কোনো ত্রুটি নেই। সবাই পুরো যত্ন ও নিয়ম মেনে তাঁকে সাহায্য করছেন। কিন্তু হুমায়ুনের রোগ সেরে যাচ্ছে না। সব চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। |
“যত দিন যায়, দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়- জীবন-প্রদীপ নিভিয়া আসিছে অন্তরবির প্রায়।“ | দিন যত যাচ্ছে, হুমায়ুনের কষ্ট তত বাড়ছে। তাঁর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। হুমায়ুনের জীবন-প্রদীপ (জীবনশক্তি) নিভে আসছে, অর্থাৎ তাঁর মৃত্যু খুব কাছাকাছি। এখানে “অন্তরবি” মানে সূর্য অস্ত যাওয়া, যা মৃত্যুর প্রতীক। |
“শুধাল বাবর ব্যগ্রকণ্ঠে ভিষকবৃন্দে ডাকি, ‘বল বল আজি সত্যি করিয়া, দিও নাকো মোরে ফাঁকি,“ | বাবর খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে চিকিৎসকদের ডাকলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন। “সত্য কথা বলো, আমাকে কোনো মিথ্যা আশা দিও না।” |
“এই রোগ হতে বাদশাজাদার মুক্তি মিলিবে নাকি?’“ | বাবর জিজ্ঞাসা করলেন, “এই রোগ থেকে হুমায়ুনের মুক্তি মিলবে কি? |
“নতমস্তকে রহিল সবাই, কহিল না কোন কথা, মুখর হইয়া উঠিল তাঁদের সে নিষ্ঠুর নীরবতা“ | চিকিৎসকরা মাথা নিচু করে রইলেন এবং কোনো উত্তর দিলেন না। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, হুমায়ুনের অবস্থা আশাহীন। তাদের নীরবতা খুবই কষ্টদায়ক এবং নিষ্ঠুর মনে হলো। |
“শেলসম আসি বাবরের বুকে বিধিল কিসের ব্যথা!“ | চিকিৎসকদের নীরবতা বাবরের হৃদয়ে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করল, যেন একটি তীক্ষ্ণ অস্ত্র তাঁর বুকে বিঁধল। |
“হেনকালে এক দরবেশ উঠি কহিলেন- ‘সুলতান, সবচেয়ে তব শ্রেষ্ঠ যে-ধন দিতে যদি পার দান,“ | এমন সময় একজন দরবেশ উঠে দাঁড়ালেন এবং বাবরকে বললেন, “হে সুলতান…” দরবেশ বললেন, “আপনার সবচেয়ে প্রিয় ধন যদি আপনি দান করতে পারেন…” |
“খুশি হয়ে তবে বাঁচাবে আল্লা বাদশাজাদার প্রাণ।“ | তাহলে আল্লাহ খুশি হয়ে হুমায়ুনের জীবন বাঁচাবেন।” |
“শুনিয়া সে কথা কহিল বাবর শঙ্কা নাহিক মানি- ‘তাই যদি হয়, প্রস্তুত আমি দিতে সেই কোরবানি,“ | বাবর দরবেশের কথা শুনে কোনো ভয় না করে বললেন… “যদি তাই হয়, তাহলে আমি সেই কোরবানি দিতে প্রস্তুত।” |
“সবচেয়ে মোর শ্রেষ্ঠ যে ধন জানি তাহা আমি জানি।“ | “আমি জানি, আমার সবচেয়ে প্রিয় ধন হলো আমার নিজের জীবন।” |
“এতেক বলিয়া আসন পাতিয়া নিরিবিলি গৃহতল গভীর ধেয়ানে বসিল বাবর শান্ত অচঞ্চল,“ | এ কথা বলে বাবর শান্ত হয়ে একটি নির্জন ঘরে গেলেন। তিনি গভীর ধ্যানে বসে গেলেন এবং শান্ত ও স্থির হয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন। |
“প্রার্থনারত হাতদুটি তাঁর, নয়নে অশ্রুজল। কহিল কাঁদিয়া- ‘হে দয়াল খোদা, হে রহিম রহমান,“ | বাবর হাত জোড় করে প্রার্থনা করছিলেন, তাঁর চোখে অশ্রু ঝরছিল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হে দয়ালু আল্লাহ, হে করুণাময়…” |
“মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারি আপন প্রাণ,“ | “আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ধন হলো আমার নিজের জীবন…” |
“তাই নিয়ে প্রভু পুত্রের প্রাণ কর মোরে প্রতিদান।’“ | .তাই আমি তোমার কাছে উৎসর্গ করছি। এর বিনিময়ে আমার পুত্রের জীবন বাঁচাও।” |
“স্তব্ধ-নীরব গৃহতল, মুখে নাহি কারো বাণী“ | ঘরটি সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। |
“গভীর রজনী, সুপ্তি-মগন নিখিল বিশ্বরাণী,“ | গভীর রাত, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। পুরো বিশ্ব যেন ঘুমের কোলে শান্ত। |
“আকাশে বাতাসে ধ্বনিতেছে যেন গোপন কি কানাকানি।“ | আকাশে এবং বাতাসে যেন কানাকানির শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আল্লাহ বাবরের প্রার্থনা শুনেছেন। |
“সহসা বাবর ফুকারি উঠিল ‘নাহি ভয় নাহি ভয়,“ | হঠাৎ বাবর চিৎকার করে বললেন, “ভয় নেই, ভয় নেই…” |
“প্রার্থনা মোর কবুল করেছে আল্লাহ যে দয়াময়,“ | “…আল্লাহ আমার প্রার্থনা কবুল করেছেন। তিনি খুবই দয়ালু।” |
“পুত্র আমার বাঁচিয়া উঠিবে মরিবে না নিশ্চয়।“ | আমার পুত্র নিশ্চয়ই বেঁচে উঠবে। সে মরবে না। |
“ঘুরিতে লাগিল পুলকে বাবর পুত্রের চারিপাশ“ | বাবর আনন্দে পুলকিত হয়ে হুমায়ুনের চারপাশে ঘুরতে লাগলেন। |
“নিরাশ হৃদয় সে যেন আশার দৃপ্ত জয়োল্লাস,“ | আগে তিনি খুবই নিরাশ ছিলেন, কিন্তু এখন আশায় ভরে গেছেন। তাঁর মনে আনন্দের জয়োল্লাস। |
“তিমির রাতের তোরণে তোরণে উষার পূর্বাভাস।“ | অন্ধকার রাতের শেষে ভোরের আলো দেখা দিচ্ছে। এখানে হুমায়ুনের রোগমুক্তির আশাকে ভোরের আলোর সাথে তুলনা করা হয়েছে। |
“সেইদিন হতে রোগ-লক্ষণ দেখা দিল বাবরের,“ | সেই দিন থেকে বাবর নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। |
“হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিল শয্যা সে মরণের,“ | কিন্তু তিনি খুবই আনন্দিত মনে মৃত্যুর শয্যা গ্রহণ করলেন। |
“নতুন জীবনে হুমায়ুন ধীরে বাঁচিয়া উঠিল ফের।“ | এর ফলে হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং নতুন জীবন ফিরে পেলেন। |
“মরিল বাবর- না, না ভুল কথা, মৃত্যু কে তারে কয়?“ | বাবর মারা গেলেন, কিন্তু আসলে তাঁর মৃত্যু হলো না। কারণ, আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি অমর হয়ে গেছেন। |
“মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়,“ | বাবর মারা গেলেও তাঁর আত্মত্যাগের গল্প চিরকাল মানুষের মনে থাকবে। তাঁর কোনো ক্ষয় নেই। |
“পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়!“ | পিতার স্নেহ এতটাই মহান যে, তা মৃত্যুকেও জয় করে ফেলেছে। বাবরের আত্মত্যাগের মাধ্যমে মৃত্যু পরাজিত হয়েছে। |