রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সুভা’ গল্পের মাধ্যমে বোবা মেয়েটির হৃদয়ের গভীর কষ্টকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সুভার নিঃশব্দ ভালোবাসা, তার বোবা কান্না, তার প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকার আকুলতা—সব মিলিয়ে এটি এক অমর কাহিনী লিখেছেন। নিচে সুভা গল্পের মূলভাব ও বিষয়বস্তু দেওয়া হল।
সুভা গল্পের মূলভাব
সুভাষিণী, সংক্ষেপে সুভা, জন্মের পর কেউ ভাবেনি সে বোবা হবে। তার দুই বোনের নামের সঙ্গে মিল রেখে তার নাম রাখা হয়েছিল, কিন্তু সে কথা বলতে পারত না। বোবা হওয়ার কারণে সবাই তাকে বোঝা মনে করত, বিশেষ করে তার মা, যিনি মেয়েটিকে নিজের গর্ভের কলঙ্ক মনে করতেন। তবে তার বাবা তাকে ভালোবাসতেন। সুভার কথা না থাকলেও তার বড় বড় চেহারা-ভরা চোখ ছিল, যেখানে তার সব আবেগ প্রকাশ পেত। মানুষের সঙ্গ সে খুব বেশি পেত না, তাই প্রকৃতি ও পশুর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সে গরু, ছাগল, বিড়াল—এই প্রাণীদের আপন করে নেয়, আর তারা ভাষাহীন হয়েও তার দুঃখ বুঝতে পারত। তার একমাত্র মানুষ-সঙ্গী ছিল প্রতাপ, গ্রাম্য যুবক, যে মাছ ধরতে ভালোবাসত। প্রতাপের কাছে সুভা ছিল এক নীরব সঙ্গী, যে শুধু পাশে বসে তার সঙ্গে সময় কাটাত। সুভার মনে হতো, যদি সে কোনো অলৌকিক শক্তি পেত, তাহলে প্রতাপকে অবাক করে দিত! কিন্তু জীবন কখনো মনের মতো হয় না। সুভার মা-বাবা তার বিয়ের কথা ঠিক করে এবং তাকে শহরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিদায়ের দিন, প্রতাপ ঠাট্টা করে বলে, “তোর বর জুটেছে নাকি?” কথাটা শুনে সুভার মন ভেঙে যায়। সে বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে, কিন্তু কিছুই বদলায় না। যাবার আগের রাতে সুভা শেষবারের মতো তার প্রিয় নদীর তীরে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, যেন সে ধরিত্রীকে আকুল মিনতি করে বলছে, “আমাকে ছেড়ে দিও না!”
সুভা গল্পের বিষয়বস্তু
সুভাষিণী, ডাকনাম সুভা, ছিল এক বোবা মেয়ে। জন্মের সময় কেউ ভাবতেও পারেনি যে সে কথা বলতে পারবে না। তার বাবা-মা তার আগের দুই বোনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তার নাম রেখেছিলেন ‘সুভাষিণী’, যার অর্থ ‘মিষ্টি ভাষিণী’। কিন্তু বিধির লিখন যে অন্য ছিল! তার দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সুভা ছিল পিতামাতার এক নীরব বোঝা। বোবা হওয়ার কারণে সবাই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল। কেউ ভাবতেও পারেনি যে কথা বলতে না পারলেও সে অনুভব করতে পারে, ভালোবাসতে পারে। তাই সবাই তার সামনে নির্দ্বিধায় তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বলত। ছোটবেলা থেকেই সে বুঝতে পারত যে সে পরিবারের জন্য এক অভিশাপের মতো। তাই নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতে চাইত, যেন সবাই তাকে ভুলে যায়।
সুভা প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসত। তার বাড়ির পাশে ছিল একটি ছোট্ট নদী। সে প্রতিদিন নদীর তীরে বসে থাকত, নদীর কলধ্বনি শুনত, গাছের পাতার মর্মর শুনত, পাখির ডাক শুনত। প্রকৃতির সঙ্গে সে কথা বলত, যদিও মুখে কোনো শব্দ আসত না। যেন প্রকৃতি তার ভাষার অভাব পূরণ করত। তার একমাত্র বন্ধু ছিল তাদের গরু দুটি—সর্বশী ও পাঙ্গুলি। সে কথা বলতে না পারলেও, গরু দুটি বুঝতে পারত সে কী বলতে চায়। সে যখন দুঃখ পেত, তখন তাদের কাছে গিয়ে বসত। তারা তার গা ঘেঁষে আদর করত, যেন বোবা মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এছাড়াও তার একটি বিড়ালছানা ছিল, যা প্রায়ই তার কোলে এসে ঘুমিয়ে পড়ত।
গ্রামের গোঁসাইদের ছোট ছেলে প্রতাপ ছিল অলস, সে সারাদিন ছিপ নিয়ে নদীর ধারে বসে মাছ ধরত। প্রতাপের খুব বেশি কাজ ছিল না, তাই সে অনেকটা গ্রামের সরকারি বাগানের মতো ছিল—যেখানে সবাই নির্দ্বিধায় যেতে পারে।সুভার সঙ্গে প্রতাপের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। প্রতাপ তাকে ‘সু’ বলে ডাকত। সুভা প্রতিদিন প্রতাপের জন্য পান সাজিয়ে আনত, তার মাছ ধরার সময় পাশে বসে থাকত।
অবশেষে তার বাবা ঠিক করলেন, তাকে কলকাতায় নিয়ে যাবেন। হয়তো সেখানে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে। এ কথা শুনে সুভা বোবা চোখে সব বুঝতে পারল। সে মনে মনে জানত, সে কোথাও যেতে চায় না। সে তার গরুদের, নদীর ধারে কাটানো দিনগুলোর, প্রতাপের কথা ভাবতে লাগল। যেদিন তার যাওয়ার দিন ঠিক হলো, সে প্রতাপের কাছে গেল। প্রতাপ তখনো মাছ ধরছিল। সে হেসে বলল, “তুই নাকি বিয়ে করতে চলেছিস? আমাদের ভুলিস না কিন্তু!” কলকাতায় যাওয়ার আগের রাতে সুভা আর থাকতে পারল না। সে চুপচাপ বেরিয়ে নদীর তীরে গিয়ে বসে পড়ল। সে যেন ধরিত্রীর বুকে নিজেকে সমর্পণ করতে চাইল। সে নদীকে, গাছপালাকে, আকাশের নক্ষত্রদের ডেকে বলল—“তোমরা আমাকে যেতে দিও না! আমি এখানেই থাকতে চাই!”