হুমায়ুন আজাদের “ফাগুন মাস” কবিতায় কবি ফাগুন মাসের সৌন্দর্য এবং এর সাথে জড়িত দুঃখ ও সংগ্রামের ইতিহাসকে একত্রিত করেছেন। নিচে ফাগুন মাস কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।
ফাগুন মাস কবিতার মূলভাব
হুমায়ুন আজাদের “ফাগুন মাস” কবিতায় ফাগুন মাসের প্রাণবন্ততা ও দুঃখকে একসাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই মাসে প্রকৃতি নতুন জীবন পায়—পাথর ভেদ করে ঘাস গজায়, শক্ত ডাল ফেঁড়ে সবুজ পাতা বের হয়, এবং বনে-মাঠে সবুজের সমারোহ দেখা দেয়। কিন্তু ফাগুন মাস শুধু সৌন্দর্যের মাস নয়, এটি দুঃখ ও সংগ্রামেরও মাস। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের স্মৃতি এই মাসে বিশেষভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কবি বলছেন, ফাগুন মাসে মায়ের চোখে জল আসে, বোনেরা হারানো ভাইয়ের জন্য কাঁদে, এবং ভাইয়েরা সংগ্রামে নামে। এই মাসে প্রতিটি বাঙালির বুকের ভেতর শহিদ মিনার জেগে ওঠে, যা ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের স্মৃতি ও গৌরবকে মনে করিয়ে দেয়। ফাগুন মাস তাই শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, সংগ্রাম ও আবেগেরও মাস।
ফাগুন মাস কবিতার ব্যাখ্যা
লাইন | ব্যাখ্যা |
“ফাগুনটা খুব ভীষণ দস্যি মাস পাথর ঠেলে মাথা উঁচোয় ঘাস।” | কবি এখানে ফাল্গুন মাসকে “দস্যি” বা চঞ্চল বলেছেন। কারণ এই মাসে প্রকৃতি নতুন প্রাণ পায়, নতুন পাতা গজায়। এমনকি যেখানে কঠিন পাথর আছে, সেখানেও ঘাস জন্মাতে পারে। এটি প্রকৃতির শক্তি ও নবজাগরণের প্রতীক। |
“হাড়ের মতো শক্ত ডাল ফেঁড়ে সবুজ পাতা আবার ওঠে বেড়ে।” | শীতকালে গাছের ডাল শুষ্ক ও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু ফাগুন মাস এলেই সেই শক্ত ডাল চিরে নতুন সবুজ পাতা বের হয়। এটি প্রকৃতির পুনর্জন্ম ও প্রাণশক্তির উদাহরণ। |
“সকল দিকে বনের বিশাল গাল ঝিলিক দিয়ে প্রত্যহ হয় লাল।” | কবি বলছেন, ফাল্গুন মাসে গাছের নতুন পাতা আর ফুলে চারপাশ যেন বদলে যায়। পলাশ, শিমুলের মতো লাল ফুলে বনভূমি যেন লাল রঙে ঝলমল করে ওঠে। |
“বাংলাদেশের মাঠে বনের তলে ফাগুন মাসে সবুজ আগুন জ্বলে।” | এখানে “সবুজ আগুন” বলতে বোঝানো হয়েছে বসন্তের প্রাণচাঞ্চল্য। শীত শেষে মাঠ-ঘাটে সবুজ ফসল, গাছপালা বেড়ে ওঠে, যা দেখতে আগুনের মতো তেজস্বী মনে হয়। |
“ফাগুনটা খুব ভীষণ দুঃখী মাস হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস।” | বসন্তের এই ফাগুন মাস শুধু আনন্দের নয়, এটি দুঃখেরও। কারণ এই মাসেই বাংলা ভাষার জন্য শহিদদের আত্মত্যাগের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাতাসেও যেন দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে। |
“ফাগুন মাসে গোলাপ কাঁদে বনে কান্নারা সব ডুকরে ওঠে মনে।” | ফাগুনের আগমনে প্রকৃতি সজীব হলেও, শহিদদের স্মরণে মন ভারী হয়ে ওঠে। এমনকি প্রকৃতির ফুলও যেন শোক প্রকাশ করে। |
“ফাগুন মাসে মায়ের চোখে জল ঘাসের ওপর কাঁপে যে টলমল।” | শহিদদের মায়েরা তাঁদের সন্তানদের হারানোর বেদনায় কাঁদেন, তাঁদের চোখের জল ঘাসের ওপর পড়ে টলমল করে। এটি মায়ের শোক ও হারানোর কষ্ট বোঝায়। |
“ফাগুন মাসে বোনেরা ওঠে কেঁদে হারানো ভাই দুই বাহুতে বেঁধে।” | শহিদদের বোনেরা তাঁদের হারানো ভাইদের কথা মনে করে কাঁদেন। তাঁরা শূন্য বুক জড়িয়ে ধরে শোক প্রকাশ করেন। |
“ফাগুন মাসে ভাইয়েরা নামে পথে ফাগুন মাসে দস্যু আসে রথে।” | ভাইয়েরা নামে পথে— ভাষার অধিকারের জন্য প্রতিবাদকারী ছাত্র-তরুণেরা রাস্তায় নেমেছিল। দস্যু আসে রথে— পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের দমন করতে আসে। “দস্যু” শব্দটি অত্যাচারী শাসকদের বোঝায়, আর “রথ” মানে তাদের শক্তি বা দমনকারী বাহিনী। |
“ফাগুন মাসে বুকের ক্রোধ ঢেলে ফাগুন তার আগুন দেয় জ্বেলে।” | কবি বলছেন, ভাষা আন্দোলনের সময় বাঙালিরা তাদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। তারা ফাগুনের মতোই আগুন জ্বেলে প্রতিবাদ করেছিল। |
“বাংলাদেশের শহর গ্রামে চরে ফাগুন মাসে রক্ত ঝরে পড়ে।” | একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে শহিদদের রক্ত ঝরেছিল, যা পুরো দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। |
“ফাগুন মাসে দুঃখী গোলাপ ফোটে বুকের ভেতর শহিদ মিনার ওঠে।” | “দুঃখী গোলাপ” বলতে শহিদদের স্মৃতিকে বোঝানো হয়েছে। শহিদ মিনার শুধু ইট-পাথরের স্থাপনা নয়, এটি প্রতিটি বাঙালির মনে গেঁথে আছে। |
“সেই যে কবে কয়েকজন খোকা ফুল ফোটালো-রক্ত থোকা থোকা—” | এখানে “কয়েকজন খোকা” বলতে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের বোঝানো হয়েছে, যারা তরুণ বয়সে জীবন দিয়েছিলেন। “ফুল ফোটালো-রক্ত থোকা থোকা”— অর্থাৎ তারা নিজের রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিল। |
“গাছের ডালে পথের বুকে ঘরে ফাগুন মাসে তাদেরই মনে পড়ে।” | শহিদদের আত্মত্যাগের কথা মনে পড়ে চারপাশের প্রকৃতিতে, শহরে, গ্রামে, মানুষের মনে। |
“সেই যে কবে—তিরিশ বছর হলো- ফাগুন মাসের দু-চোখ ছলোছলো।” | কবিতা লেখার সময় ভাষা আন্দোলনের ৩০ বছর পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফাগুন মাস এলেই সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা মনে পড়ে, তাই এটি কষ্টের মাসও। |
“বুকের ভেতর ফাগুন পোষে ভয়- তার খোকাদের আবার কী যে হয়!” | কবি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তিনি ভাবছেন, শহিদদের মতো আবারও কি নতুন প্রজন্মকে জীবন দিতে হবে? |