জসীমউদ্দীনের ‘রুপাই’ কবিতায় গ্রামের এক চাষার ছেলে রুপাইয়ের কথা বলা হয়েছে। রুপাই দেখতে কালো, কিন্তু তার এই কালো রঙ প্রকৃতির সৌন্দর্যের মতোই অনন্য। নিচে জসীমউদ্দীনের রুপাই কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।
রুপাই কবিতার মূলভাব
জসীমউদ্দীনের ‘রুপাই’ কবিতাটি গ্রামের এক কালো চাষার ছেলে রুপাইয়ের গল্প। রুপাই দেখতে কালো, কিন্তু তার এই কালো রঙ প্রকৃতির মতোই সুন্দর। তার চুল লম্বা, শরীর সরু, আর চোখে-মুখে এক মায়া আছে। কবি বলেছেন, কালো রঙ খারাপ নয়—কালো কালি দিয়ে যেমন সব বই লেখা হয়, তেমনি রুপাইয়ের কালো রঙও তাকে বিশেষ করে তোলে।
রুপাই শুধু সুন্দর নয়, সে খুব পরিশ্রমীও। সে লাঠি খেলায় দক্ষ, গান গায়, আর গ্রামের সব কাজে সাহায্য করে। গ্রামের লোকেরা তাকে ‘পাগাল লোহা’ বলে ডাকে, কারণ সে খুব শক্তিশালী। কবি বলেছেন, রুপাই সোনার চেয়েও দামি, কারণ তার কাজ এবং ব্যক্তিত্ব সবাইকে মুগ্ধ করে। একদিন তার নামে পুরো গ্রাম পরিচিত হবে।
রুপাই কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল, কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!” | এই লাইনে কবি গ্রামের এক চাষার ছেলে রুপাইয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। তার চুল লম্বা, মুখ কালো, এবং তার সৌন্দর্য প্রকৃতির মতোই অনন্য। কালো ভ্রমর এবং রঙিন ফুলের সাথে তুলনা করে কবি বলেছেন, রুপাইয়ের সৌন্দর্য প্রকৃতির মতোই সুন্দর। |
“কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি-মুখের মায়া, তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।” | রুপাইয়ের মুখ কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি এবং মায়াময়। তার সৌন্দর্যে যেন নতুন ঘাসের ছায়া মিশে আছে, যা তাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। |
“জালি লাউয়ের ডগার মতো বাহু দুখান সরু, গা খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু।” | রুপাইয়ের বাহু লাউয়ের কচি ডগার মতো সরু, আর তার শরীর শাওন (শ্রাবণ) মাসের তমাল গাছের মতো সুঠাম এবং সুন্দর। |
“বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে দেছে তেল, বিজলি মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল। | রুপাইয়ের শরীর বাদল-ধোয়া মেঘের মতো কালো এবং মসৃণ। তার সৌন্দর্যে যেন বিজলির আলো ছড়িয়ে পড়েছে, যা তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। |
“কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি, কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরান লেখি।” | কবি বলেছেন, রুপাইয়ের কালো চোখ দিয়েই সে সবকিছু দেখে, আর কালো কালি দিয়েই পৃথিবীর সব বই লেখা হয়। অর্থাৎ, কালো রঙ কোনো খারাপ জিনিস নয়, বরং কালো কালি দিয়েই মহিমান্বিত কুরআন লেখা হয়েছে। |
“জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়; চাষিদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।” | কবি বলেছেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবই কালো রঙে ভরা। রুপাইয়ের মতো কালো চাষার ছেলেরাই কর্মের গুনে জীবনে জয়ী হয়। |
“সোনায় যে-জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার ‘ রং পেলে ভাই গড়তে পারি রামধনুকের হার।” | কবি বলেছেন, সোনা দিয়ে সোনা বানানো যায়, কিন্তু রুপাইয়ের মতো কালো রঙ দিয়ে রামধনুকের হারও (অর্ধবৃত্তাকার রংধনু) বানানো যায়। অর্থাৎ, কালো রঙেরও নিজস্ব মহিমা আছে। |
“কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন, তারির পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।” | রুপাইয়ের মতো যারা কালো রঙ দিয়েও আলো ছড়ায়, তাদের পায়ের ধুলোর জন্য বৃন্দাবনও (মথুরার নিকটবর্তী হিন্দুদের তীর্থস্থান।) লুটায়। অর্থাৎ, তাদের মহিমা অসাধারণ। |
“সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ, কালো-বরন চাষির ছেলে জুড়ায় যেন বুক।” | কবি বলেছেন, রুপাই সোনা বা পিতল নয়, কিন্তু তার কালো রঙ এবং ব্যক্তিত্ব সবার মন জুড়ায়। |
“যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও ! সেই কালোতে সিনান করি উজল তাহার গাও।” | রুপাইয়ের কালো রঙ তার গ্রাম এবং ধানের মাঠের মতোই সুন্দর। এই কালো রঙেই তার শরীর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। |
“আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী, খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি।” | রুপাই লাঠি খেলায় খুব দক্ষ, এবং সবাই তাকে নিজের দলে নিতে চায়। |
“জারির গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে, ‘শাল-সুন্দি-বেত’ যেন ও, সকল কাজেই লাগে।” | জারির গানে রুপাইয়ের কণ্ঠ সবার আগে শোনা যায়। সে গ্রামের সব কাজে উপকারী, যেমন শাল, সুন্দি, বেতের মতো। |
“বুড়োরা কয়, ছেলে নয় ও, পাগাল লোহা যেন, রুপাই যেমন বাপের বেটা কেউ দেখেছ হেন?” | গ্রামের বুড়োরা বলে, রুপাই কোনো সাধারণ ছেলে নয়, সে ইস্পাতের মতো শক্তিশালী। তার মতো ছেলে খুব কমই দেখা যায়। |
“যদিও রুপা নয়কো রুপাই, রুপার চেয়ে দামি, এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামি।” | কবি বলেছেন, রুপাই রূপা নয়, কিন্তু সে রূপার চেয়েও দামি। একদিন তার নামে পুরো গ্রাম পরিচিত হবে। |