আহসান হাবীবের “আমি কোনো আগন্তুক নই” কবিতাটি প্রকৃতিপ্রেম, মাটির প্রতি ভালোবাসা এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্কের এক অনবদ্য প্রকাশ। নিচে আমি কোন আগন্তুক নই কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।
আমি কোন আগন্তুক নই কবিতার মূলভাব
এই কবিতায় কবি বলছেন যে তিনি তার জন্মভূমি, প্রকৃতি এবং মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তিনি কোনো “আগন্তুক” বা অচেনা অতিথি নন, বরং এই জায়গারই অংশ। কবি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমন আকাশ, মাটি, নদী, গাছপালা, পাখি ইত্যাদির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে দেখান। তিনি বলছেন, এই প্রকৃতি তাকে চেনে, আর তিনিও প্রকৃতিকে চেনেন। কবি গ্রামীণ জীবনের ছবি এঁকেছেন—ধানক্ষেত, সরু পথ, নদীর কিনার, শূন্য রান্নাঘর, শুকনো থালা ইত্যাদি। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষ যেমন কদম আলী, জমিলার মা’র সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কের কথা বলেছেন। তাদের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। কবির হাতে লাঙলের স্পর্শ, মাটির গন্ধ, শরীরে মাটির সুবাস—এসবই তার মাটির প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ। তিনি মাটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। কবিতাটির শেষে কবি বলছেন, তিনি এই নদী, ধানক্ষেত এবং গ্রামীণ জীবনেরই অংশ। তিনি কোনো আগন্তুক নন, বরং এই প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আমি কোনো আগন্তুক নই কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতার লাইন | ব্যাখ্যা |
“আসমানের তারা সাক্ষী, সাক্ষী এই জমিনের ফুল” | কবি বলছেন, আকাশের তারা এবং মাটির ফুল তার সাক্ষী। অর্থাৎ, তারা তার অস্তিত্বকে চেনে এবং প্রমাণ করে যে তিনি এই জায়গারই অংশ। |
“এই নিশিরাইত বাঁশবাগান, বিস্তর জোনাকি সাক্ষী” | গভীর রাতে বাঁশবাগানে জোনাকির আলো জ্বলছে। এই জোনাকিরাও কবির সাক্ষী, অর্থাৎ তারা তাকে চেনে। |
“সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী পুবের পুকুর” | জারুল ও জামরুল গাছ এবং পূর্ব দিকের পুকুরও কবির সাক্ষী। তারা কবির অস্তিত্বকে স্বীকার করে। |
“তার ঝাকড়া ডুমুরের ডালে স্থির দৃষ্টি মাছরাঙা আমাকে চেনে” | ডুমুর গাছের ডালে বসে থাকা মাছরাঙা পাখিও কবিকে চেনে। অর্থাৎ, প্রকৃতির সব উপাদানই কবির সঙ্গে পরিচিত। |
“আমি কোনো অভ্যাগত নই, খোদার কসম আমি ভিনদেশি পথিক নই” | কবি দৃঢ়ভাবে বলছেন, তিনি কোনো অতিথি বা বিদেশি পথিক নন। তিনি এই জায়গারই অংশ। |
“আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে এখানেই থাকি” | কবি বলছেন, তিনি এখানে সব সময় থেকেছেন এবং স্বপ্নের মতো নিয়মে এখানেই থাকবেন। তিনি কোনো নতুন অতিথি নন। |
“আর এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা—সারা দেশে” | কবি বলছেন, এখানে থাকার অর্থই হলো সারা দেশে থাকা। অর্থাৎ, তিনি এই মাটির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। |
“এই খর রৌদ্র, জলজ বাতাস, মেঘ, ক্লান্ত বিকেলের পাখিরা আমাকে চেনে” | রোদ, বাতাস, মেঘ এবং বিকেলের ক্লান্ত পাখিরাও কবিকে চেনে। তারা জানে যে তিনি তাদেরই অংশ। |
“তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই” | প্রকৃতির সব উপাদান জানে যে কবি তাদেরই আত্মীয়। তিনি তাদের থেকে আলাদা নন। |
“কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী, সাক্ষী তার চিরোল পাতার টলমল শিশির” | কার্তিক মাসের ধানের শিষ এবং পাতার উপর টলটলে শিশিরও কবির সাক্ষী। তারা কবির অস্তিত্বকে স্বীকার করে। |
“সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা নিশিন্দার ছায়া” | জ্যোৎস্নায় ঢাকা নিশিন্দা গাছের ছায়াও কবির সাক্ষী। তারা কবির অস্তিত্বকে চেনে। |
“অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী, তার ক্লান্ত চোখের আঁধার—আমি চিনি” | কবি গ্রামের কদম আলী বৃদ্ধকে চেনেন, যার চোখে ক্লান্তি ও আঁধার দেখা যায়। তিনি তার দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারেন। |
“আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন” | কবি বলছেন, তিনি কদম আলীর চিরচেনা আত্মীয়। তিনি তার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। |
“আমি জমিলার মা’র শূন্য খাঁ খাঁ রান্নাঘর, শুকনো থালা সব চিনি” | কবি জমিলার মা’র শূন্য রান্নাঘর এবং শুকনো থালা চেনেন। তিনি তাদের অভাব-অনটন বুঝতে পারেন। |
“হাত রাখো বৈঠায় লাঙলে, দেখো আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর” | কবি বলছেন, লাঙলে হাত রাখলে দেখা যাবে যে তার হাতের স্পর্শ সেখানে গভীরভাবে লেগে আছে। অর্থাৎ, তিনি মাটির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। |
“দেখো মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস” | কবির শরীরে মাটির গন্ধ লেগে আছে। তিনি মাটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। |
“আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই” | কবি শেষবারের মতো বলছেন, তিনি কোনো আগন্তুক নন। তিনি এই মাটিরই অংশ। |
“দু’পাশে ধানের খেত, সরু পথ, সামনে ধু ধু নদীর কিনার আমার অস্তিত্বে গাঁথা” | ধানের খেত, সরু পথ এবং নদীর কিনার—এসবই কবির অস্তিত্বের সঙ্গে গাঁথা। তিনি এই প্রকৃতিরই অংশ। |
“আমি এই উধাও নদীর মুগ্ধ এক অবোধ বালক” | কবি নিজেকে নদীর মুগ্ধ এক বালক হিসেবে দেখেন। তিনি এই নদীরই অংশ। |