ঝর্ণার গান কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “ঝরনার গান” কবিতাটি প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং ঝরনার চঞ্চল গতিকে কেন্দ্র করে রচিত। নিচে ঝর্ণার গান কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।

ঝর্ণার গান কবিতার মূলভাব

ঝরনাটি পাহাড় থেকে নেমে আসে, তার পা চঞ্চল এবং সে সব সময় গান গায়। ঝরনাটি পাথরের উপর দিয়ে ছুটে চলে, নির্জন পাহাড়ে কোনো শব্দ নেই। সে একলা গান গায়, একলা ছুটে চলে, দিন-রাত, সকাল-সন্ধ্যা—সব সময়ই সে ছুটে চলে। ঝরনাকে পাহাড় ভয় দেখাতে চায়, কিন্তু তার কোনো ভয় নেই। সে সমান গতিতে ছুটে চলে, তার পায়ে নূপুর বাজে। কোনো পাহাড়ের বরফ গলে তার জন্ম হয়েছে, কিন্তু সে এসবের খবর রাখে না। সে শুধু আনন্দে ছুটে চলে, খিলখিল করে হাসে, বুলবুল পাখির মতো গান গায়। ঝরনাটি বনের ঝাউ গাছের পাশ দিয়ে ছুটে যায়, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, দুলিয়ে চলে। শালিক পাখি এবং টিয়া পাখি ঝরনার কোমল জলের ধারায় মুখ ভেজায়।

ঝরনাটি নিচে নেমে আসে, আর শুনতে পায় কেউ তাকে “ফটিক জল” বলে ডাকছে। যার সুন্দরের তৃষ্ণা আছে, ঝরনা তারই খোঁজে ছুটে চলে। তার খোঁজেই ঝরনার কোনো বিরাম নেই। সে তরল সুর ও কবিতার মতো গান গায়। চকোর পাখি যেমন চাঁদের আলো খোঁজে, ঝরনাও তেমনি মুগ্ধ চোখ খোঁজে। ঝরনাটি তার চঞ্চল পায়ে ছুটে চলে, পাথরের উপর দিয়ে ঝিলিক দেয়, মন ভোলায়, চারদিক ঝিলমিল করে তোলে।

ঝর্ণার গান কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“চপল পায় কেবল ধাই, কেবল গাই পরীর গান”ঝরনাটির পা খুব চঞ্চল, সে সব সময় ছুটে চলে এবং পরীর মতো মিষ্টি গান গায়। তার গতি এবং গান দুটোই খুব সুন্দর।
“পুলক মোর সকল গায়, বিভোল মোর সকল প্রাণ”ঝরনার সমস্ত শরীর আনন্দে ভরে ওঠে, এবং তার সমস্ত প্রাণ মুগ্ধ হয়ে যায়। সে প্রকৃতির সৌন্দর্যে মগ্ন।
“শিথিল সব শিলার পর চরণ থুই দোদুল মন”ঝরনাটি ঢিলে পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে যায়, তার মন দোদুল্যমান, অর্থাৎ তার গতি খুব নরম এবং মসৃণ।
“দুপুর-ভোর ঝিঁঝিঁর ডাক, ঝিমায় পথ, ঘুমায় বন”দুপুর থেকে ভোর পর্যন্ত ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়, পথ ঘুমায়, বনও ঘুমায়। চারদিক খুব শান্ত এবং নির্জন।
“বিজন দেশ, কূজন নাই নিজের পায় বাজাই তাল”চারদিকে খুব নির্জন, কোনো পাখির ডাক নেই। ঝরনাটি নিজের পায়ের শব্দেই তাল মিলিয়ে চলে।
“একলা গাই, একলা ধাই, দিবস রাত, সাঁঝ সকাল”ঝরনাটি একলা গান গায়, একলা ছুটে চলে। দিন-রাত, সকাল-সন্ধ্যা—সব সময়ই সে ছুটে চলে।
“ঝুঁকিয়ে ঘাড় ঝুম-পাহাড় ভয় দ্যাখায়, চোখ পাকায়”ঝুম-পাহাড় ঝরনাকে ভয় দেখাতে চায়, কিন্তু ঝরনার কোনো ভয় নেই। সে সমান গতিতে ছুটে চলে।
“শঙ্কা নাই, সমান যাই, টগর-ফুল-নূপুর পায়”ঝরনার কোনো ভয় নেই, সে সমান গতিতে ছুটে চলে। তার পায়ে টগর ফুলের মতো নূপুর বাজে।
“কোন গিরির হিম ললাট ঘামল মোর উদ্ভবে”কোনো পাহাড়ের বরফ গলে তার জন্ম হয়েছে। সে পাহাড়ের কপাল থেকে নেমে এসেছে।
“কোন পরীর টুটুল হার কোন নাচের উৎসবে”কোনো পরীর হার ছিঁড়ে গেছে, কোনো নাচের উৎসব থেকে সে এসেছে। কিন্তু সে এসবের খবর রাখে না।
“খেয়াল নাই-নাই রে ভাই পাই নি তার সংবাদই”ঝরনাটির এসবের কোনো খবর নেই। সে শুধু আনন্দে ছুটে চলে।
“ধাই লীলায়, খিলখিলাই-বুলবুলির বোল সাধি”ঝরনাটি খেলার ছলে ছুটে চলে, খিলখিল করে হাসে, বুলবুল পাখির মতো গান গায়।
“বন-ঝাউয়ের ঝোপগুলায় কালসারের দল চরে”ঝরনাটি বনের ঝাউ গাছের ঝোপের পাশ দিয়ে ছুটে যায়, কালসার পাখির দল শিলার উপর চরে বেড়ায়।
“শিং শিলায়-শিলার গায়, ডালচিনির রং ধরে”পাথরের উপর দিয়ে ঝরনাটি ছুটে যায়, তার জলের রং ডালচিনির মতো সুন্দর।
“ঝাঁপিয়ে যাই, লাফিয়ে ধাই, দুলিয়ে যাই অচল-ঠাঁট”ঝরনাটি লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, দুলিয়ে চলে, পাথরের উপর দিয়ে ছুটে যায়।
“নাড়িয়ে যাই, বাড়িয়ে যাই-টিলার গায় ডালিম-ফাট”ঝরনাটি টিলার গায়ে ডালিম ফলের মতো তার গতি দেখায়।
“শালিক শুক বুলায় মুখ থল-ঝাঁঝির মখমলে”শালিক পাখি এবং টিয়া পাখি ঝরনার কোমল জলের ধারায় মুখ ভেজায়।
“জরির জাল আংরাখায় অঙ্গ মোর ঝলমলে”ঝরনার শরীর জরির জালের মতো ঝলমলে।
“নিম্নে ধাই, শুনতে পাই ‘ফটিক জল।’ হাঁকছে কে”ঝরনাটি নিচে নেমে আসে, আর শুনতে পায় কেউ তাকে “ফটিক জল” বলে ডাকছে।
“কণ্ঠাতেই তৃষ্ণা যার নিক না সেই পাঁক ছেঁকে”যার গলা শুনেই তৃষ্ণা পায়, সে এই কাদা জল পান করে না।
“গরজ যার জল স্যাঁচার পাতকুয়ায় যাক না সেই”যার জল স্যাঁচার করার শক্তি আছে, সে পাতকুয়ায় যাক।
“সুন্দরের তৃষ্ণা যার আমরা ধাই তার আশেই”কিন্তু যার সুন্দরের তৃষ্ণা আছে, ঝরনা তারই খোঁজে ছুটে চলে।
“তার খোঁজেই বিরাম নেই বিলাই তান-তরল শ্লোক”তার খোঁজেই ঝরনার কোনো বিরাম নেই। সে তরল সুর ও কবিতার মতো গান গায়।
“চকোর চায় চন্দ্রমায়, আমরা চাই মুগ্ধ-চোখ”চকোর পাখি যেমন চাঁদের আলো খোঁজে, ঝরনাও তেমনি মুগ্ধ চোখ খোঁজে।
“চপল পায় কেবল ধাই উপল-ঘায় দিই ঝিলিক”ঝরনাটি তার চঞ্চল পায়ে ছুটে চলে, পাথরের উপর দিয়ে ঝিলিক দেয়।
“দুল দোলাই মন ভোলাই, ঝিলমিলাই দিগ্বিদিক”ঝরনাটি মন ভোলায়, চারদিক ঝিলমিল করে তোলে।

Related Posts

Leave a Comment