তাহারেই পড়ে মনে কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

সুফিয়া কামালের ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি প্রকৃতির সৌন্দর্য, ঋতু পরিবর্তন এবং মানবিক আবেগের মেলবন্ধনকে ফুটিয়ে তোলে। নিচে তাহারেই পড়ে মনে কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হল।

তাহারেই পড়ে মনে কবিতার মূলভাব

এই কবিতায় কবি বসন্তের আগমন নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু তার মন বসন্তের আনন্দে ভরে উঠেনি। বসন্ত এসেছে, প্রকৃতি সাজসজ্জায় ভরে উঠেছে, কিন্তু তিনি কেন নীরব? কেন তিনি বসন্তের বন্দনা গাইছেন না? কবি উত্তরে বলেন যে, তার মন এখনও অতীতের স্মৃতিতে আটকে আছে। তার মন এখনও শীতের স্মৃতিতে আটকে আছে। তিনি মাঘ মাসের শীতল সন্ন্যাসীর কথা ভাবছেন, যে শীতের শেষে চলে গেছে কিন্তু তার স্মৃতি এখনও কবির মনে জাগরূক। শীতের সেই রিক্ততা ও শূন্যতা তাকে এখনও তাড়া করে ফেরে। তাই বসন্তের সৌন্দর্য তাকে আনন্দ দিতে পারেনি।

কবিতাটি আসলে কবির ব্যক্তিগত শোক ও বিষণ্নতার কথা বলে। কবির স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের মৃত্যুর পর তার জীবনে এক গভীর শূন্যতা নেমে আসে। এই শোক তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, বসন্তের মতো আনন্দের ঋতুও তার মনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। কবির মন এখনও অতীতের শীতের স্মৃতিতে আটকে আছে, যে শীত তাকে শূন্যতা ও বেদনা দিয়ে গেছে। তাই বসন্তের সৌন্দর্য তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

তাহারেই পড়ে মনে কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কবিকে জিজ্ঞাসা করছেন, “হে কবি, বসন্ত (ফাগুন) এসেছে, প্রকৃতি সাজসজ্জায় ভরে উঠেছে, কিন্তু তুমি কেন চুপ করে আছ? তুমি কেন বসন্তের বন্দনা গাইছ না?” প্রশ্নকারী জানতে চাইছেন, কবি কেন এই আনন্দের ঋতুকে উপেক্ষা করছেন।
”কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?”
কবি জিজ্ঞাসা করছেন, “দক্ষিণের দরজা খুলে গেছে কি না? (বসন্তের মৃদু বাতাস এসেছে কি না?) বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? আমের মুকুল ফুটেছে কি?” এগুলো বসন্তের লক্ষণ, কিন্তু কবি যেন তা দেখতে পাচ্ছেন না বা উপভোগ করছেন না।
“দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”কবি বলছেন, “দক্ষিণের মৃদু বাতাস কি ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে উঠেছে? প্রকৃতি কি আনন্দে ভরে উঠেছে?” কিন্তু কবির মন এখনও সেই আনন্দে সাড়া দিচ্ছে না।
“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম, “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কবিকে জিজ্ঞাসা করছেন, “তুমি কি এখনও বসন্তের সৌন্দর্য দেখনি? তুমি আজ কেন এত উদাসীন? তুমি কেন নতুন ফুলের সাজে নিজেকে সাজাওনি?” কবির এই উদাসীনতা প্রশ্নকারীকে বিস্মিত করছে।
”কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?”
কবি বলছেন, “অদৃশ্য সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বসন্তের তরী কি এসেছে? বসন্তের আগমনী গান কি বেজেছে?” কবি যেন বসন্তের আগমন টের পাচ্ছেন না, কারণ তার মন অন্য চিন্তায় ব্যস্ত।
“ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই, রাখি নি সন্ধান।”কবি বলছেন, “বসন্ত কি আমাকে ডেকেছে? আমি তা শুনিনি, আমি তার সন্ধানও রাখিনি।” কবির মন এখনও অতীতের স্মৃতিতে আটকে আছে, তাই তিনি বসন্তের ডাক শুনতে পাননি।
“ওগো কবি! রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি- এ মোর মিনতি।”
প্রশ্নকারী কবিকে অনুরোধ করছেন, “হে কবি, আজও তুমি গান রচনা করো না কেন? আমি তোমার কণ্ঠে বসন্তের বন্দনা শুনতে চাই।” তিনি কবির কাছ থেকে বসন্তের গান শুনতে চাইছেন।
”কহিল সে মৃদু মধু-স্বরে- “নাই হলো, না হোক এবারে-“কবি বলছেন, “না হয় এবার গান গাওয়া হলো না।” কবির মন এখনও শোকাচ্ছন্ন, তাই তিনি বসন্তের আনন্দে অংশ নিতে পারছেন না। তিনি বলছেন, এবার হয়তো গান গাওয়া হবে না।
“আমারে গাহিতে গান, বসন্তেরে আনিতে বরিয়া-
রহেনি, সে ভুলেনি তো, এসেছে তা ফাগুনে স্মরিয়া।”
কবি বলছেন, “আমাকে গান গাইতে হবে, বসন্তকে স্বাগত জানাতে হবে—এমন ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু বসন্ত আমাকে ভুলেনি, সে ফাগুনে এসে আমাকে স্মরণ করেছে।” কবির মন এখনও শোকাচ্ছন্ন, তাই তিনি বসন্তের আনন্দে অংশ নিতে পারছেন না। যদিও বসন্ত এসেছে, কিন্তু কবির মন এখনও অতীতের স্মৃতিতে আটকে আছে।
“ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
প্রশ্নকারী কবিকে বলছেন, “হে কবি, তুমি কি অভিমান করেছ? বসন্ত এসেছে, কিন্তু তুমি তাকে উপেক্ষা করলে।” প্রশ্নকারী কবির এই বিমুখতা দেখে বিস্মিত হচ্ছেন।
”কহিল সে পরম হেলায়-
বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটেনি শাখে? পুষ্পারতি লভেনি কি ঋতুর রাজন?”
 কবি বলছেন, “বৃথা কেন? ফাগুনের দিনে কি ফুল ফোটেনি? বসন্ত কি তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেনি?” প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন ঘটেছে, কিন্তু কবির মন এখনও শীতের স্মৃতিতে আটকে আছে।
“মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নাই অর্ঘ্য বিরচন?”কবি বলছেন, “মাধবী ফুলের কুঁড়িতে কি গন্ধ নেই? বসন্ত কি তার অর্ঘ্য (উপহার) তৈরি করেনি?” প্রকৃতি বসন্তের সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে, কিন্তু কবির মন এখনও অতীতের শোকে ভারাক্রান্ত।
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম, “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
প্রশ্নকারী কবিকে বলছেন, “হয়েছে, তবুও তুমি বসন্তের প্রতি এত বিমুখ কেন? তুমি কেন ঋতুরাজ বসন্তকে উপেক্ষা করে তাকে ব্যথা দিচ্ছ?” প্রশ্নকারী কবির এই বিমুখতা দেখে দুঃখ পাচ্ছেন।
“কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনো মতে।”
কবি বলছেন, “শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা মাঘ মাসের সন্ন্যাসী (শীত) ধীরে ধীরে চলে গেছে, ফুলশূন্য দিগন্তের পথে, খালি হাতে। শীতের সেই স্মৃতি আমার মনে পড়ে, আমি তা কোনোভাবেই ভুলতে পারি না।” কবির মন এখনও শীতের শূন্যতা ও ব্যক্তিগত শোকে আচ্ছন্ন।

Related Posts

Leave a Comment