বোশেখ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা – আল মাহমুদ

আল মাহমুদের “বোশেখ” কবিতাটি বৈশাখ মাসের প্রচণ্ড বাতাসের মাধ্যমে প্রকৃতির শক্তি এবং মানুষের জীবনের সংগ্রামের কথা বলে। নিচে বোশেখ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেয়া হল।

বোশেখ কবিতার মূলভাব

আল মাহমুদের “বোশেখ” কবিতাটি বৈশাখের প্রচণ্ড বাতাসকে কেন্দ্র করে লেখা, যা প্রকৃতির শক্তিশালী রূপকে ফুটিয়ে তোলে। এই বাতাস বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে দেয়, জেট প্লেনের পাখা ভেঙে ফেলে, নদীর পানি শূন্যে ছড়িয়ে দেয় এবং টেলিগ্রাফের থামগুলোকে নুইয়ে দেয়। কিন্তু কবি লক্ষ্য করেন, এই ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় গরিব মানুষ—মাঝির নৌকার দড়ি ছিঁড়ে যায়, চাষির ঘর উড়ে যায়, টুনটুনি পাখির বাসা ভেঙে পড়ে। অথচ ধনীদের প্রাসাদ অক্ষত থাকে।

কবি বাতাসের কাছে আবেদন করেন, যদি ধ্বংস করতেই হয়, তবে যেন তা অবিচার ও শোষণের প্রতীক ধনীদের অট্টালিকা গুঁড়িয়ে দেয়। তিনি বাতাসকে রাজা সোলেমানের বাহন হিসেবে কল্পনা করেন, যার তলোয়ার অত্যাচারীর মাথা কাটতে পারে। কবি চান, ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠিত হোক। কবি গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলেছেন এবং ধনীদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

বোশেখ কবিতার ব্যাখ্যা

কবিতার লাইনব্যাখ্যা
“যে বাতাসে বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে যায়
জেটের পাখা দুমড়ে শেষে আছাড় মারে”
বৈশাখের বাতাস এতই শক্তিশালী যে এটি প্রকৃতি ও মানুষের তৈরি জিনিস সবকিছুকেই ধ্বংস করে দেয়। বুনোহাঁসের ঝাঁক বাতাসের তাণ্ডবে ভেঙে যায়। জেট প্লেনের পাখা, যা আধুনিক প্রযুক্তির প্রতীক, বাতাসের সামনে দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়ে।
“নদীর পানি শূন্যে তুলে দেয় ছড়িয়ে
নুইয়ে দেয় টেলিগ্রাফের থামগুলোকে।”
নদীর পানি শূন্যে ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি টেলিগ্রাফের থাম, যা মানুষের তৈরি স্থাপনা, বাতাসের সামনে নুইয়ে পড়ে। এই লাইনগুলোতে কবি বৈশাখের বাতাসের ধ্বংসাত্মক রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
“সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি
তিষ্ঠ হাওয়া, তিষ্ঠ মহাপ্রতাপশালী,”
কবি এখানে কালবৈশাখীর কাছে মিনতি করছেন, যেন সে একটু শান্ত হয়। ‘তিষ্ঠ’ শব্দের অর্থ—স্থির হও, শান্ত হও। এই প্রবল বাতাসের শক্তি রয়েছে। যেন তার ধ্বংসাত্মক শক্তি গরিব মানুষের উপর না পড়ে।
“গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কী লাভ?
কী সুখ বলো গুঁড়িয়ে দিয়ে চাষির ভিটে?”
কিন্তু সেই শক্তি যেন গরিব মাঝির পাল ছিঁড়ে নষ্ট না করে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে বা চাষির ঘর গুঁড়িয়ে দিয়ে কী লাভ? এই ধ্বংসে কার কী সুখ?
“বেগুন পাতার বাসা ছিঁড়ে টুনটুনিদের
উল্টে ফেলে দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি”
কবি বাতাসের ধ্বংসের আরও উদাহরণ দেন। বাতাস টুনটুনি পাখির বাসা ভেঙে দেয়। এমনকি এটি দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি উল্টে ফেলে, যা গরিব মানুষের জীবনকে আরও কষ্টকর করে তোলে। কবির এই কথাগুলো বোঝায় যে প্রকৃতির প্রতিকূলতা সবসময় যেন দরিদ্রদের উপরই আঘাত হানে, যা সমাজের চরম বৈষম্যকেই প্রতিফলিত করে।
“হে দেবতা, বলো তোমার কী আনন্দ,
কী মজা পাও বাবুই পাখির ঘর উড়িয়ে?”
কবি যেন ঝড়ের শক্তিকে দেবতা রূপে কল্পনা করে প্রশ্ন করছেন—এত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে তার কী আনন্দ হয়? বাবুই পাখির সুন্দর কারুকার্য করা বাসা উড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতি কী আনন্দ পায়? এই প্রশ্নের মাধ্যমে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে প্রকৃতি যেন দরিদ্র ও নিরীহ প্রাণীদের সঙ্গেই বেশি নিষ্ঠুর আচরণ করে।
“রামায়ণে পড়েছি যার কীর্তিগাথা
সেই মহাবীর হনুমানের পিতা তুমি?”
এখানে কবি পৌরাণিক প্রসঙ্গ এনেছেন। হনুমান ছিলেন বায়ুর দেবতা ‘বায়ু’-এর পুত্র। রামায়ণে বলা হয়েছে, বায়ু অনেক শক্তিশালী দেবতা, যিনি অনেক কিছুই ধ্বংস করতে পারেন। কবি তাই প্রশ্ন করছেন, এই বৈশাখী ঝড় কি সেই একই দেবতার সৃষ্টি, যে কেবলই ধ্বংস করে যায়?
“কালিদাসের মেঘদূতে যার কথা আছে
তুমিই নাকি সেই দয়ালু মেঘের সাথী?”
কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে মেঘকে ভালোবাসা ও আশার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কবি এখানে আবার প্রশ্ন করছেন—বৈশাখের ঝড় কি সেই দয়ালু মেঘের বন্ধু? যদি তাই হয়, তবে এটি এত নিষ্ঠুর কেন? কবির বক্তব্য এখানে প্রকৃতির বৈপরীত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে।
“তবে এমন নিঠুর কেন হলে বাতাস
উড়িয়ে নিলে গরিব চাষির ঘরের খুঁটি”
কবি প্রকৃতির কাছে আবারও প্রশ্ন রাখছেন—তুমি যদি এত শক্তিশালী হও, তবে কেন কেবল গরিবদের ঘর ভেঙে দাও? কেন বাতাস গরিব চাষির ঘরের খুঁটি উড়িয়ে নেয়?
“কিন্তু যারা লোক ঠকিয়ে প্রাসাদ গড়ে
তাদের কোনো ইট খসাতে পারলে নাতো।”
কেন ধনীদের বিশাল প্রাসাদের কোনো ক্ষতি করো না? কবি এখানে প্রকৃতির অবিচারকে সমাজের অবিচারের সঙ্গেও তুলনা করেছেন, যেখানে দরিদ্ররা সবসময় ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কিন্তু ধনী ও ক্ষমতাবানরা নিরাপদে থাকে। এটি সমাজের বৈষম্য ও অবিচারের প্রতি কবির তীব্র প্রতিবাদ।
“হায়রে কতো সুবিচারের গল্প শুনি,
তুমিই নাকি বাহন রাজা সোলেমানের”
কবি সুবিচারের গল্প স্মরণ করেন। কবি এখানে ধর্মীয় প্রসঙ্গ এনেছেন। ইসলামি ঐতিহ্য অনুযায়ী, বায়ু ছিল রাজা সোলেমানের বাহন। সোলেমান ছিলেন ন্যায়বিচারক রাজা, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতেন।
“যার তলোয়ার অত্যাচারীর কাটতো মাথা
অহমিকার অট্টালিকা গুঁড়িয়ে দিতো।”
যার তলোয়ার অত্যাচারীর মাথা কাটতে পারে এবং অহংকারী মানুষের অট্টালিকা গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কবি চান, বাতাস যদি সত্যিই শক্তিশালী হয়, তবে যেন তা অত্যাচারী ও অবিচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
“কবিদের এক মহান রাজা রবীন্দ্রনাথ
তোমার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন করজোড়ে”
কবি রবীন্দ্রনাথের কথা স্মরণ করেন, যিনি বাতাসের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন করজোড়ে, পুরানো ও অদরকারি জিনিস উড়িয়ে দিতে।
“যা পুরানো শুষ্ক মরা, অদরকারি
কালবোশেখের একটি ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে।”
রবীন্দ্রনাথের মতো কবি চান, বাতাস যেন পুরানো ও অপ্রয়োজনীয় জিনিস ধ্বংস করে নতুন সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করে।
“ধ্বংস যদি করবে তবে, শোনো তুফান
ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের”
কবি এখানে স্পষ্টভাবে ঝড়ের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন—যদি ধ্বংসই করতে হয়, তবে তা হওয়া উচিত সমাজের অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। 
“পরের শ্রমে গড়ছে যারা মস্ত দালান
বাড়তি তাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে ফেলো।”
যারা শোষণের মাধ্যমে বড় বড় প্রাসাদ গড়েছে, তাদের ধ্বংস করো। প্রকৃতির শক্তি যেন শুধুমাত্র দরিদ্রদের কষ্ট না বাড়িয়ে, বরং অত্যাচারী ও শোষকদের পতন ঘটায়।

Related Posts

Leave a Comment